সুগত সান্যাল

 

গল্পের নাম পড়ে যদি ভেবে থাকেন আমি কলকাতার ইডেন গার্ডেনে আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি এবং সেখানে ডাইনোসর দেখাবো, সেটা মারাত্মক ভুল হবে। এই ঘটনা আরো অনেক গভীর।
আমার বন্ধু প্রফেসর প্রশান্ত বোস একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। ওঁর একটা পি এইচ ডি ডিগ্রি আছে পদার্থবিদ্যাতে। তবে আমি ভেবে পাই না যে পৃথিবীর কোন বিষয়টা ওঁর অজানা। মলিকিউলার বায়োলজি থেকে থিওরি অফ রিলেটিভিটি, সবেতেই ওনার সমান আগ্রহ।
আমি কমলেশ মিত্র, প্রশান্ত বাবুর বাড়ির কাছে একটা ছোট মেসে থাকি। বি কম পাস করে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কেরানির কাজ করি। উনি আমায় বেশ ভালোবাসেন কিন্তু সেটা যে কেন আমি বুঝতে পারি না। উনি তো ইচ্ছে করলেই অনেক বাঘা বাঘা লোকের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, উনি যখন কথা বলেন, আমি সাধারণতঃ চুপচাপ থাকি, মন দিয়ে সব কথা শুনি, আর মাঝে মধ্যে ‘হাঁ’ ‘না’ বলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিই। প্রফেসর বোস অনেক কিছু বলে যান, উনি জানেন আমার কাছ থেকে কোন খবর কারো কাছে যাবে না। আগে অনেক লোক ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুদ্ধি নিয়েছে আর তারপর যন্ত্রপাতি তৈরি করে টু-পাইস ইনকাম করেছে। প্রফেসর বোস টাকা অথবা খ্যাতি, এসবের জন্য পরোয়া করেননা। ওঁর নিজের প্রচুর টাকা, আর বাপ-ঠাকুরদার কাছ থেকেও প্রচুর পেয়েছেন। ব্যক্তিগত নাম-ডাকের কোন মোহও ওঁর নেই। তবে কেউ ওঁকে বোকা বানিয়ে চলে যাবে সেটা উনি সহ্য করতে পারেন না। অসৎ লোকের ধারে কাছে উনি থাকেন না।
প্রশান্ত বাবুর একটা ভালো অভ্যাস আছে। উনি যদিও থিয়োরিটিক্যাল বিষয়ে পি এইচ ডি করেছেন, বিভিন্ন ধরণের যন্ত্র তৈরি করা ওঁর সখ এবং উনি তাতে খুব আনন্দ পান। মানসিক ইচ্ছা দিয়ে চালানো যে ওভেন এবং টোস্টার উনি তৈরি করেছেন, সেটা দেখলে লোকে পাগল হয়ে যাবে। তবে আমি কঠিন ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কাউকে কোন দিন কিছু বলতে পারব না, আর আমিও কখনো ওঁর বিশ্বাস ভঙ্গ করিনি।

একদিন সন্ধ্যাবেলা মুশলধারে বৃষ্টি নেমেছে, আমি এসে জমে গেছি, খুব গল্প হচ্ছে। নরহরি, ওঁর কাজের লোক, এক থালা চিকেন পকৌড়া দিয়ে গেছে। এখানে এলে আমার খাওয়াটা বেশ জমাটি হয়। ছুটির দিনে দুপুরের আর প্রায় প্রতি রাতেরই খাওয়া আমার এখানেই হয়।
সেদিন উনি হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কমলেশবাবু, আপনার কি বহু পুরনো দিনের জীবন্ত প্রাণী দেখতে ইচ্ছে করে?”
আমি ভাবলাম, এবার আবার নতুন কি চিন্তা ওঁর মাথায় খেলছে। এত বড় এক জন প্রতিভাশালী মানুষের ভাবনার ধারা বোঝা শক্ত। আমি বললাম, আমার ইচ্ছে করে পিরামিড তৈরি, তাজমহল তৈরি হওয়া দেখতে। দা ভিঞ্চি মোনালিসা আঁকছেন দেখতে পেলেও ভালো লাগবে।
প্রশান্তবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন। ওঁর বক্তব্য হোল যে আমার চিন্তাধারার মাপটা ছোটো। আমি শুধু কয়েক হাজার বছরের গণ্ডীতে ভাবছি। আর ওঁর মন ভাবছে লাখ লাখ অথবা কোটি কোটি বছরের মাপে। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে আমি এই মাপে ভাবিনি। আমি সহজে হার স্বীকার করাতে উনি খুশী হয়ে ওঁর চিন্তাধারার রাশ আলগা করলেন। আমি বহুবার দেখেছি যে এটাই সব থেকে সহজ।

উনি বললেন যে উনি বহুদিন ধরে এই নিয়ে চিন্তা করে আসছেন। আর অনেক কিছু কাজ এবং অঙ্ক কষে ফেলেছেন, এরই মধ্যে। আমি অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আমি দেখেছি যে ওঁর চিন্তাধারার গতি এবং দিক বোঝা শক্ত। তার চেয়ে সহজ হল ওঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া। আর তাতে উনিও খুব খুশী হন। ওঁর আনন্দ হল একদম নতুন কিছু তৈরি করায়, যে সব জিনিষ সাধারণ লোক কল্পনাও করতে পারবেনা। টাকা বা যশ, এসবে ওঁর কোন মোহ নেই। তাই উনি পেপার লেখা বা পেটেন্ট নেওয়ার ব্যাপারে খুবই উদাসীন এবং শুধু মুষ্টিমেয় কিছু বৈজ্ঞানিকই ওঁর খ্যাতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল।
বেশ কিছু বছর আগে উনি ‘টেলিপোর্টিং’ যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। আমরা দুজনে সেই যন্ত্র চড়ে ‘আলাস্কা’ ঘুরে এসেছিলাম। কিন্তু এতো বেশি ঠাণ্ডা সেখানে যে আমি ওঁকে প্রায় পায়ে ধরে ফেরৎ এসেছিলাম, কিছুই দেখা হয়নি। ওঁর তৈরি ‘টেলিপোর্টিং’ যন্ত্রটা দেখতে খুবই সাধারণ, একটা পুরনো কার্পেটের মতন। উনি ওই কার্পেটের ওপর এক বিশেষ পদ্ধতিতে একটা রাসায়নিকের সংযোজনা করেছেন, তা ছাড়া কিছু দিক এবং গতি পরিবর্তনের যন্ত্র লাগানো আছে, তার বিশদ বিবরণ শুধু উনিই জানেন। আজকাল ওটাকে দিয়ে ওঁদের দাদুর আমলের পিয়ানোটা ঢাকা থাকে, তাতে লোকের বিশেষ নজরে পড়েনা। উনি সব সময়ে ওঁর এই ঘরটি নিজের তৈরি ‘ম্যাজিক তালা’ দিয়ে বন্ধ করে রাখেন। এই তালার একটা মহা গুণ হোলো যেই প্রধান দরজাটাতে ম্যাজিক তালা পড়ে, বাকী দরজা ও জানলাগুলো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। আমি এর সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারবো না, কিন্তু একটা মজার কথা বলি, কেউ যদি কোনও জানলা বা দরজা জোর করে খোলার চেষ্টা করে, তার কপালে জোটে এক রাম চড়। বেশ জোরাল চড়। আমি চড় খাওয়া লোকের কান্নার শব্দ শুনছি। আমরা সেদিন অন্য ঘরে বসেছিলাম।

ভাগ্যবশতঃ, প্রশান্ত বাবু আমাকে খুব স্নেহের চক্ষে দ্যাখেন। আমাকে কোনও জিনিস বোঝাতে হলে উনি একদম সহজ করে শুরু করেন। আর শেষ অব্দি আমিও বুঝে যাই। ওঁর বোঝানর ক্ষমতাও অসাধারণ। এর সব কিছুর শুরুতে হচ্ছে আমার ওপর ওঁর বিশ্বাস।
উনি আমাকে বললেন, “কমলেশবাবু, আমি একটা যন্ত্রের কথা ভাবছি, যেটা আমাদের অতীতে… বহু প্রাচীন সময়ে কি ঘটেছিল, সেটা দেখতে সাহায্য করবে।” আমি একটু অবাক হলাম। আমি এই ধরণের যন্ত্রের কথা গল্পের বইয়ে পড়েছি, তবে কারো সঙ্গে এই নিয়ে কখনো কথা হয়নি। আরো জানার আগ্রহে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এই যন্ত্রের ব্যাপারটা একটু বিশদে জানান না, সহজ করে, আমার বোঝার মতন করে।”
“এটা খুবই সহজ ব্যাপার। আমি বেশ কিছুদিন হোলো, এর বৈজ্ঞানিক থিওরি, সব অঙ্ক কষে ঠিক করে রেখেছি,” প্রশান্ত বাবু জানালেন। “আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি। আপনি তো শুনেছেন লোকে বলে যে ‘তারা’ বিস্ফোরণ হওয়া দেখেছে। বৈজ্ঞানিকরা এই ঘটনাকে ‘সুপারনোভা’ বলে থাকেন। আসলে আপনি যেটা এখন দেখছেন, সেই তারার বিস্ফোরণ হয়তো কোটি কোটি বছর আগে হয়েছে, এবং সেই আলো এত বছর বাদে এসে আমাদের কাছে দেখা দিয়েছে। আপনি যেটা এখন দেখছেন, সেই বিস্ফোরিত তারা এখন পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছে, বহুদিন আগে।”
আমি খুব বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়ালাম। সত্যি কথা বলতে কি, কোটি কোটি বছর আগে তারার বিস্ফোরণ এবং আমাদের বহু প্রাচীন জীবিত প্রাণী দেখা, আমি এর মধ্যে কোন সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমার অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে ঠিক সময়ে প্রশান্ত বাবু নিজেই সব সমাধান করে দিয়ে থাকেন।
প্রশান্ত বোস আরো বিশদভাবে এই অতীতের জীব দেখবার ব্যাপারটা বোঝাতে শুরু করলেন। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমার সেই ‘টেলিপোর্টিং’ যন্ত্রের কথা মনে আছে কিনা? আমি জোরে ঘাড় নাড়লাম, আমি কি করে সেই ‘আলাস্কা’ ভ্রমণের কথা ভুলে যাব।
প্রশান্ত বাবু জানালেন যে আমরা যদি পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূরে যেতে পারি, তাহলে আমদের বহু পুরনো দিনের ঘটনা দেখতে পাওয়া উচিৎ। আমি এবার আরো জোরে ঘাড় নাড়লাম। কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথাতে সমানে পাক মারছিল, অত দূর থেকে আমরা পৃথিবীতে কিছু দেখব কেমন করে? আমি ওঁকে এটা জিজ্ঞেস করলাম।
উনি আমার এই প্রশ্ন শুনে খুব খুশী হয়ে উঠলেন। বললেন, “খুব ভাল বলেছেন, এটা তো মাথাতেই আসেনি। শুধু দূরে যাওয়াটা নিয়েই ভেবেছি।” ওঁর মতন একজন বড় বৈজ্ঞানিক এই বিরাট প্রয়োজনীয় ব্যাপারটা ভুলে গেছিলেন, তাতে ওঁর বিন্দুমাত্র ক্ষোভ হয় নি। উল্টে উনি আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমারও বেশ খুশী খুশী লাগছিল। উনি বললেন এটার উত্তর খুঁজে পেতে কিছু সময় লাগবে। আমি রাজী হয়ে গেলাম।

সেদিন ছিল শুক্রবার, তারপর একটা পুরো সপ্তাহ কেটে গেলো, কিন্তু প্রশান্ত বাবুর কোন খবর নেই। আমি এক দিন ওঁর বাড়ি গিয়ে নরহরিকে জিজ্ঞেস করে এলাম, সেও কোন কিছু বলতে পারলো না। খালি বলল যে সে মাঝে মাঝে প্রশান্ত বাবুকে পাতলা কাঁচ অথবা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল জাতীয় জিনিস নিয়ে বাড়ীতে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছে। নরহরি ঠিক পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারলো না। আমিও বুঝলাম যে অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আমাদের আর কিছু করার নেই।

পরের সপ্তাহের সোমবার সকালবেলায় হঠাৎ ডাক এলো। মেসের ম্যানেজার বাবুর ঘরে দেখি নরহরি, হাঁপাচ্ছে, এক গ্লাস জল শেষ করে আর এক গ্লাস জল খাচ্ছে। আমাকে বলল যে প্রশান্ত বাবু আমাকে এখুনি ওর সঙ্গে যেতে অনুরোধ করেছেন। আমি যেন কয়েক দিনের মতন কাপড়-জামা নিয়ে যাই। বুঝতে পারলাম যে আমাদের আবার অনির্দেশ যাত্রার পালা এসেছে।
আমি অবশ্য মনে মনে এই যাত্রার জন্য তৈরি ছিলাম। কথা বলে সময় নষ্ট না করে আমি দু-তিনটি শার্ট-প্যান্ট নিয়ে নিলাম। আর আলাস্কার অভিজ্ঞতা মনে রেখে আমার ঠাকুরদাদার দেওয়া একটি বিশাল ওভারকোটও নিলাম। এই ওভারকোট উনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে সৈন্যদের ‘ওয়ার-সারপ্লাস’ দোকান থেকে কিনেছিলেন, ওঁর পরে বাবা, বাবার পরে এটা এখন আমার কাছে এসেছে। তবে কে জানতো যে আমাদের এইবারের ভ্রমণের পরিধি অনেক অনেক বেশি হবে।
প্রশান্তবাবুর বাড়ী গিয়ে দেখি উনি বেশ উত্তেজিত। সমানে পায়চারি করছেন বসার ঘরেতে। এক কোনে দুটি অদ্ভুত যন্ত্র রাখা আছে। এর মধ্যে একটা আমাদের পুরনো ম্যাজিক কার্পেট। সেটাকে ঝাড় পোঁছ করা হয়েছে আর একটা অ্যালুমিনিয়ামের খাঁচার মত জিনিসের মাথায় সেটা রাখা রয়েছে। খাঁচার সামনেটা খোলা। ভেতরে দুটি বসার জায়গা রয়েছে। অনেকটা যেন পালকির মতন দেখাচ্ছে। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করাতে উনি ওনার মার্কামারা সূক্ষ্ম হাসিটা হাসলেন। “মনে পড়ে কমলেশ বাবু, গত বার আলাস্কা থেকে ফেরার পথে আপনি কার্পেট থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমরা খুব দ্রুত বেগে আর অনেক উঁচু দিয়ে আসছিলাম। তাই এবারে এই ব্যবস্থা করেছি। এতে আমরা একটু আরামে বসতেও পারব আর মজা করে সারা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে ঘুরতেও পারবো।” ঘটনাটা যদিও মজার বলে মনে হচ্ছিল না, কিন্তু মনে হোল এখন চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই আস্তে আস্তে পরিস্কার হবে, ওঁর পরের কথাতে কিছুটা আলোকপাত হোল।
“দেখুন কমলেশ বাবু, আমরা যদি অনেক পুরনো ঘটনা দেখতে চাই, তা হোলে আমাদের পৃথিবীর থেকে দূরে যেতে হবে, তাই না?” আমি সায় দিলাম। প্রশান্ত বাবু বললেন, “তা হলে ডাইনোসর দেখতে হলে আমাদের অনেক অনেক দূরে যেতে হবে।” দূরত্ব বোঝাতে উনি বেশ কিছু অঙ্ক আমাকে দেখাতে উৎসাহী হয়ে উঠছিলেন, আমি তাড়াতাড়ি বিষয়টা পালটে ফেললাম। অঙ্ক নিয়ে আমি কি করবো? আসল ঘটনা দেখতে পেলেই আমি খুশী।
“ইয়ে… বহু দূর থেকে দেখার ব্যাপারটা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। উনি একটা হাল্কা হাসিতে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে ওঁর ব্যাপারটা মনে আছে। উনি দুটো বাইনোকুলার জাতীয় যন্ত্র বের করলেন। আমি ভাবলাম যে এই দিয়ে কোটি কোটি মাইল দূর থেকে কি দেখা যাবে? আমার ছোটবেলায় একটা মেলা থেকে কেনা বাইনোকুলার ছিল। তাতে একটা আমগাছের ডালপালা পরিস্কার দেখা যেতো, তবে ফুট কুড়ির বেশি দূরের জিনিস দেখতে মোটেই সুবিধে হত না।
প্রশান্ত বাবু আমার মনের কথা বুঝে নিলেন। বললেন, “এই বাইনোকুলার সাধারণ জিনিস নয়। এটাতে একটা বিশেষ পদার্থ লাগান আছে, যেটা দূরত্ব অনুসারে দেখার জোর বাড়ায় বা কমায়। অতএব, আপনি একশো ফুট বা এক কোটি মাইল, যত দূর থেকেই দেখুন, আপনি একই রকম পরিস্কার ভাবে সব জিনিস দেখতে পাবেন।”
সকাল সকাল বিশাল পরিমাণ জলখাবার খেয়ে আমরা যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করলাম। নরহরিকে বলা হোল যে কেউ যদি আমাদের খবর চায়, তাকে বলা হবে যে আমরা কমলেশ বাবুর গ্রামে বেড়াতে গেছি ।

প্রশান্ত বাবু আর আমি, দুজনে ম্যাজিক পালকিতে উঠে বসলাম। আমি ওভারকোটটাও পরে নিয়েছিলাম, আর প্রচণ্ড ঘামছিলাম। যাত্রা শুরুর আগে, আমি আমাদের সব দেব-দেবীকে মনে মনে প্রণাম করে নিয়েছি, প্রশান্ত বাবু এসবে খুব একটা বিশ্বাস করেন না।

অতীতের দিকে যাত্রা

আমাদের যাত্রা শুরু হোল। প্রশান্ত বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন অনেক দূর অতীতে যাবার আগে, আমি কোন কাছাকাছি ঘটনা দেখতে চাই কিনা। আমি বললাম প্রথমে পিরামিড তৈরী দেখতে চাই। প্রশান্ত বাবু ম্যাজিক পালকির কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ নিয়ে খুটখাট শুরু করলেন।
আমরা প্রচণ্ড গতিতে চলেছি। দূরে পৃথিবী একটা ছোটো বিন্দুর মতন দ্যাখাচ্ছে। আমাদের বিশেষ বাইনোকুলার দিয়ে দেখি বেশ পরিস্কার দেখাচ্ছে সব। আর এই যন্ত্রের একটা বিশেষ গুণ হোল, যে এটা মানুষের চিন্তাধারা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পৃথিবীর যে কোন একটা জায়গা দেখতে হোলে, সেই জায়গার কথা মনে করলেই সেখানকার ছবি ফুটে ওঠে। আমি মনে মনে পিরামিডের কথা চিন্তা করতে না করতেই দেখি কয়েক শো লোক বিরাট বিরাট পাথর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জায়গাটা মোটেই মরুভূমি নয়, বেশ ঘাসে ঢাকা, আমি সন্দেহ প্রকাশ করাতে, প্রশান্ত বাবু জানালেন যে তখন ঐসব জায়গা বেশ সবুজ ছিল। মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে অনেক পরে। পিরামিড দেখা হোল খুব দ্রুত গতিতে।

আমরা পৃথিবী থেকে আরো অনেক দূরের দিকে পাড়ি শুরু করলাম। মাঝখানে মনে হোল যে এক ঝলক মায়া সভ্যতার আভাস দেখতে পেলাম। আমদের পালকি তখন প্রচণ্ড গতিতে চলেছে। প্রশান্ত বাবু ডাইনোসর দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। হঠাৎ দেখি দূরের পৃথিবীতে মানুয দেখা যাচ্ছে তবে তাদের চেহারা একটু অন্যরকম। তাদের দেখতে অনেক বড় এবং তারা কুঁজো হয়ে হাঁটছে। আমি বললাম, “প্রশান্ত বাবু, এরা কারা?” ঊনি ভাল করে তাকিয়ে দেখে বললেন যে এরা আমাদের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ ।
বুঝলাম যে এসব দেখাও কপালে ছিল । অবশ্য প্রশান্ত বাবুর তৈরী ওই বাইনোকুলার না থাকলে এসব দেখা কপালে হোতো না ।

দেখতে দেখতে বেশ কিছু ঘণ্টা কেটে গেছে। আমার একটু ঘুম পেয়ে গেছিল। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি যে পৃথিবীর একটা জায়গায় বেশ কিছু হাতির মতন জন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে তারা হাতির থেকে আকারে অনেক বড় আর গলা বেশ লম্বা, অনেকটা জিরাফের মতন। আমার ঘুম পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে এই দেখে। আমি বুঝতে পারলাম যে আমরা ডাইনোসর বা ঐ জাতীয় কিছু জীবদের দেখছি। প্রশান্ত বাবুকে জিজ্ঞেস করাতে উনি সজোরে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
প্রশান্ত বাবু ম্যাজিক পালকি চালিয়েই চলেছেন। মুখে এক অদ্ভুত হাসি। আমি ভাবলাম যা দেখার জন্য আসা, সে সবই তো দেখা হোল, এবার তো ঘরে ফিরলেই হয়। প্রশান্ত বোস কোন কথা না বলে পালকির গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন।

আরো অতীতের দিকে

আমার ভ্রমণপর্বের এই অংশটা সব মনে নেই ঠিক মতন। যেটুকু মনে আছে তাতেই এখনো মাথা ঘুরে যায়। আমি এটুকু বুঝেছিলাম যে প্রশান্ত বাবু শুধু ডাইনোসর দেখেই থামবেন না, ওঁর মাথায় আরো কিছু দেখার মতলব আছে।
হঠাৎ আমার নজরে পড়লো যে পৃথিবীর কোথায় কে জানে সুন্দর বাগান। সেখানে গাছ, ফুল, ফল সব দেখা যাচ্ছে। ভাবলাম এত সব দেখার পর এখন বাগান দেখে কি হবে! প্রশান্ত বাবুর মুখে হাসিটা লেগে আছে তবে চোখের দৃষ্টি কিরকম যেন। একটা জিনিস দেখতে পেয়ে আমি সোজা হয়ে বসলাম। একটা বিরাট সাপ এঁকে বেঁকে চলেছে, এদিক ওদিক ঘুরে একটা গাছে উঠতে লাগল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ওটা একটা বিরাট আপেল গাছ।
আমার হঠাৎ মনে হল এটা সেই বিখ্যাত গার্ডেন অফ ইডেন নয় তো? দুটি মানুষকেও দেখতে পেলাম। প্রশান্ত বাবু ইচ্ছে করে ঐ মানুষদের একটু আবছা রেখেছেন। ওঁর যন্ত্রের কন্ট্রোল ঠিক করাতে দেখি যে আদম ও ইভকে দেখা যাচ্ছে, গায়ে কাপড়-জামা কিছু নেই। এটা আপেল খাওয়ার আগের অবস্থা ।
বলতে ভুলে গেছি, প্রশান্ত বাবু বিয়ে করেননি আর মেয়েদের সামনে উনি বেশ অপ্রতিভ হয়ে পড়েন, আর এখানে তো আরও মারাত্মক অবস্থা। সাপের বেশে শয়তান আর কিছু করার আগে, এবং ইভকে দিয়ে আদমকে আপেল খাওয়ানোর আগে, প্রশান্ত বোস তাঁর বৈজ্ঞানিকোচিত সংযম ভুলে গিয়ে কন্ট্রোলের যন্ত্রকে পুরো উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিলেন, আর আমাদের পালকি সোজা প্রশান্ত বাবুর বসার ঘরে এসে ধপাস করে পড়লো।
আমি হতভম্ব, এতবড় একটা ঘটনা দেখা হোল না। ওভারকোটটা খুলে ফেললাম। নরহরি কাছেই ছিল, তাকে বলতে না বলতে সে খুব কড়া চা আর খাবার নিয়ে এলো। এতটা ঘুরে আসার পরে আমাদের দুজনেরই খুব খিদে পেয়েছিল।

আমি প্রশান্ত বাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ডাইনোসর না আদম-ইভ, এদের কারা আগে এসেছিল, উনি উত্তর না দিয়ে অস্পষ্টভাবে খালি বললেন ওঁর ম্যাজিক পালকির কন্ট্রোলে একটু গন্ডগোল ছিল। ভেবেছিলাম যে এই পর্বের এখানেই ইতি, তা কিন্তু হোল না। কিছুদিন বাদে নরহরি ফের এসে উপস্থিত এবং আমি আবার গিয়ে পৌঁছলাম আমাদের আড্ডাখানায়। দেখলাম প্রশান্ত বাবু দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে আছেন ।

বর্তমান অবস্থা

আমি অনেক করে জিজ্ঞেস করাতে বললেন যে উনি একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন। শয়তান স্বপ্নে এসে ওঁকে শাসিয়ে গেছে। বলেছে যে এরকম বিশ্রী অবস্থার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। সেই থেকে আমাদের অতীত ভ্রমণ বন্ধ।
আমরা আজকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেখানকার খাবার খাচ্ছি। পালকিতে একটা ছোট টুল লাগিয়ে নরহরিকেও মাঝে মাঝে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ লাগে। তবে এর মধ্যে একটা জায়গায় গেছলাম, যেখানকার লোকেরা কাঁচা খাবার খায়, সে এক বাজে অভিজ্ঞতা। ওখান থেকে ঘুরে আসার পর প্রশান্ত বাবু একটা নতুন সর্ব-হজম-ক্ষম বড়ি তৈরী করছেন!!!!