তাপস কিরণ রায়

 

রাত অন্ধকার হয়। অনেক আলোর বন্যায় আমরাই তাকে স্বচ্ছতায় তুলে ধরি। আর চাঁদ, দ্য ল্যাম্প অফ দ্য নাইট, রাতের প্রকৃতিকে দেখতে আকাশে ঝোলানো থাকে! এই চাঁদের আলো, মানে, জ্যোৎস্নায়, বড় মায়া জড়িয়ে থাকে। মনে পড়লেই রোদ যেমন চিটচিটে গরম আর অস্বস্তির মানসিক উত্তেজনা নিয়ে আসতে পারে, তেমনি শান্ত নিশ্চিন্ততার ভাবনা জ্যোৎস্নার মধ্যে খুঁজে পাই।

এমনি এক আলোআঁধারি জ্যোৎস্নায় শহীদ মিনারের পাশে গার্ডেনে বসে আছে রজত। গরমের দিন, রাতের দিকে গরম কমে যায়। না ঠাণ্ডা, না গরমের মাঝখানে, আরও যদি জ্যোৎস্না রাত হয়, ভালো লাগবেই। আর ঘিঞ্জি কলকাতার রাস্তাঘাট ছেড়ে ছোটবড় কোনো বাগানে কিছু সময়ের জন্য বসলে সত্যি ভালো না লেগে পারে না। খোলা হাওয়া যেটুকু পাওয়া যায়, তাতেই মনে হয় শরীর জুড়িয়ে গেল।

রজতের ভালো লাগছিল, ও একাই এসেছিল ধর্মতলায়, ইলেকট্রনিক্স আইটেমের নাকি ভালো দোকান আছে এখানে। বেহালা, যেখানে উঠেছে রজত, সেই পর্ণশ্রীর ধারেকাছে কোথাও বড় ইলেকট্রনিক্সের দোকান নেই। আর সেই যদি কোথাও বের হতে হয়, তবে ধর্মতলা গেলে ক্ষতি কি? ঘোরায় ঘোরা হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে বেশ ক’টা দোকান ঘুরে পছন্দ মত মোবাইল কিনতে পারবে। এমনই ভেবে ধর্মতলা আসা। মোবাইলের মধ্যে এল-জি’র সেট পছন্দ করল রজত। দাম সাড়ে চার হাজার টাকা, সস্তা, সুন্দর, মজবুত। পুরোনো যে মোবাইল, যেটা তার কাজে লাগছিল, সেটা অনেক দিনের পুরোনো। ওপরটা ঘষেটষে ঔজ্বল্য হারিয়েছে। আর মডেল বড় পুরোনো ছিল, সব দিক ভেবে নতুন নেওয়া।

সন্ধ্যের মধ্যে মোবাইল তো নেওয়া হয়ে গেল, এবার কি করা যায় ভাবছিল রজত। শহীদমিনারের পাশের গার্ডেনের কথা মনে হলো তার। এদিক-ওদিক না ঘুরে নিশ্চিন্তে ক’টা মিনিট বসা যাক ভেবে গার্ডেনে এসে বসল। আশপাশে তাকিয়ে দেখল আরও বেশ কিছু লোকজন বসে আছে। দু’তিন জায়গায় যত দূর নজর যায় জোড়ে জোড়ে বসে থাকতেও দেখা গেল। গার্ডেন মানেই তো তাই, জোড়ে এসে বসে থাকার প্রশস্ত জায়গা, সামান্য আনন্দ-স্ফূর্তি, খুনসুটি, বসন্ত বয়সে সবাই এটা চায়।

খালি জায়গা নিয়েই বসে আছে রজত। পাঁচ মিনিট বসে থাকার পর উঠবে উঠবে ভাবছিল, এমনি সময় একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো তার সামনে, একটু দূরত্ব নিয়ে। রজত অবাক হল।

কি ব্যাপার? মেয়েটার হাবভাবে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। মেয়েটি মৃদু স্বরে কি যেন বলল, রজতের বোধগম্য হল না। আবার মেয়েটি ঈষৎ চাপা স্বরে বলে উঠল, সঙ্গিনী চাই?

–মানে বুঝলাম না, রজত বলে ওঠে। মনে মনে সে ভয় পায়, খারাপ মেয়েছেলে নয় তো! পটিয়ে-পাটিয়ে পয়সাকড়ি নিয়ে ভেগে পড়তে পারে।
–ভালোবাসার লোক চাই? ঈষৎ হাসি মেয়েটির মুখে, যদিও মলিনতা ঘিরে আছে তার সমস্ত শরীর।
ভয় পেয়ে যায় রজত, নিশ্চয়ই মেয়েটি দেহপসারিণী হবে। এ ধরণের ঘটনার সামনাসামনি কখনো হয়নি সে, বলে ওঠে, না, না, আমি এখন ঘরে যাব।
মেয়েটি মিষ্টি ভাবে বলে ওঠে, ঘরে তো কেউ না কেউ থাকবেই, গার্ডেনে তো আপনি একা!
–না, না, আমার কাউকে চাই না, এখনই আমি ঘরে যাব, উৎকণ্ঠায় বলে ওঠে রজত।
মেয়েটি বলে ওঠে, এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি বাঘ-ভাল্লুক নই, মানুষ, না হয় দু’টি কথা আপনার সঙ্গে প্রেমিকা হয়ে বললাম! বেশী লাগবে না, আধ ঘন্টায় বিশ টাকা দেবেন।

উঠে যেতে থাকে রজত, ভাবে, মেয়েটি বলে কি! প্রেমিকার অভিনয় করবে বিশ টাকায়! তারপর জমে গেলে আরও কত কিছুর রেট বলে বসবে। এমনি করে ফাঁসিয়ে সর্বস্বান্ত করবে।

মেয়েটি আরও একটু কাছে এল, ফিসফিস করে বলে উঠলো, জানেন, আজ সারা দিন একটি পয়সাও পাইনি, সকাল থেকে পেটে এক ঠোঙা ঝালমুড়ি ছাড়া কিছুই পড়েনি, ঘরের মা আর ভাইকে কি খাওয়াব বলুন!

রজত দাঁড়ায়। মনে হয় এমনি ভাবে ওরা কথার ফাঁদ পাতে, মিষ্টি মিষ্টি সুন্দর সুন্দর কথা বলে, তারপর নিয়মিত খদ্দের বানায় – আর লোকেদের চরিত্র হনন করে, টাকা পয়সা আত্মসাৎ করে পথে বসায়। রজত কি মনে করে পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে, মেয়েটার হাতে দিয়ে বলে, এটা রাখো।

মেয়েটি টাকা নেয় না, বলে, না এমনি এমনি আমি টাকা নিই না, আমায় বিশ্বাস করুন আমি কোনো ছলনা করছি না, এমন কি আমি আপনাকে দেহ দান করতেও আসি নি, শুধু দু’টি মিষ্টি কথার অভিনয় করে ক’টা পয়সা চাই আমি।

কি উত্তর দেবে রজত বুঝতে পারল না। বেশভূষায় মেয়েটিকে অতি সাধারণ মনে হচ্ছে। বয়স বিশ-পঁচিশের ভিতর, উগ্র সাজসজ্জা শরীরে নেই, গা থেকে পারফিউমের কোনো গন্ধ আসছে না। পরিচ্ছদে উগ্র চাকচিক্য নেই। তবে কি মেয়েটি যা বলছে তা সত্যি! কিন্তু এমনি ভাবে কি কেউ পয়সা রোজগার করতে পারে? লোকেরা এমনি ভাবে তাকে পয়সা রোজকার করতে দেবে? দু’দিন পরেই তো সে বাধ্য হবে দেহ দান করতে… তখন… যাক এতসব ভাববার তার কি দায় পড়েছে!

মেয়েটি রজতের দিকে তাকিয়ে করুণ ভাবে হাসল, বিশ্বাস করতে পারছেন না আমায়! আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি চাই না।
–না, না, আমায় যেতে হবে, আর্জেন্ট কাজ আছে।
–ঠিক আছে যান, আপনার নামটা বলবেন?
–কেন, নাম দিয়ে কি হবে?
–ধরুন অজয় আপনার নাম, আমার আপনাকে বলতে হবে, অজয়দা, কত দিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা, চলো না দু’মিনিট কোথাও বসি, আমায় কি তোমার ভালো লাগে না!
–মেয়েটি তার রোজের অভিনয়ের কিছু অংশ বলে চলে। সত্যি কি অদ্ভুত! জীবনে খুব কমই এমন চমকদার ঘটনা ঘটে।

কিন্তু রজতের হঠাৎ চমক ভাঙল তখন যখন দেখল গার্ডেনের আবছায়ায় কোনো ঝোপঝাড় থেকে দুটো মেয়ে বেরিয়ে এসে এই মেয়েটির চুল টেনে ধরল। একি! কি হচ্ছে রজতের চোখের সামনে? পরে আসা মেয়েদু’টির মধ্যে একজন বলে উঠল, হারামজাদী, বেরো এখান থেকে! আবার এসেছিস তুই! দলের অন্য মেয়েটা আরও কদর্য কিছু গালি দিয়ে, একজন চুল টেনে, আর একজন ধাক্কাতে ধাক্কাতে রজতের অভিনেত্রী প্রেমিকা মেয়েটিকে গার্ডেন থেকে বের করে দিতে তৎপর হয়ে উঠল। যেতে যেতে প্রেমিকা মেয়েটি মিনতি ভরা চোখ নিয়ে দু’তিনবার তাকাল রজতের দিকে।

সত্যি খুব খারাপ লাগছে রজতের। বেচারা, সত্যি হয়তো সারা দিন ঝালমুড়ি ছাড়া আর কিছুই তার পেটে পড়েনি। একবার মনে হল, কেন ওর হাতে পনের-বিশ টাকা গুঁজে দেয়নি!

এমনি সময় ফিরে এলো জাঁদরেল মেয়ে দুটি, রজতকে বলে উঠল, ওর পাল্লায় পড়বেন না যেন, আপনাকে দু’দিনে ছিবড়ে বানিয়ে দেবে! তারপর ওদের মুখ থেকে উত্তেজনার ভাবটা সরে গেল, শান্ত হয়ে এক জন অন্য জনকে দেখিয়ে হেসে বলল, এর সঙ্গে চলে যান ওই গাছটার আড়ালে, ওর নাম চন্দ্রা, ওর সঙ্গে ভালবাসা করুন গিয়ে।
–না, না, আমি যাচ্ছি, রজত বলে ওঠে।
–কোথায় যাবেন, সবে তো সন্ধ্যে, রজতের হাত আলতো ভাবে সুন্দর ভঙ্গিমায় তুলে ধরে চন্দ্রা। প্রেমিকার মত হাসে সে, শরীরে উগ্র পারফিউমের গন্ধ তার। গন্ধে আশপাশের জায়গাটা পর্যন্ত উৎকট হয়ে উঠেছে। হেসে চলেছে মেয়েটা রজতের মুখের দিকে চেয়ে।
–কি হল, চলুন না, মজা পাবেন, বলে নাচের ভঙ্গি করে আবার হেসে ওঠে মেয়েটা।

কি করবে এবার রজত, সাথে রাখা মোবাইল, টাকাপয়সা সবই যদি ও নিয়ে যায়! শুনেছে রজত, কথা না শুনলে ওরা নাকি আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। মায়, জামা-প্যান্ট খুলে ল্যাংটো করে ছেড়ে দেয়!
ভয় আরও জাঁকিয়ে বসল রজতের মনে, আর এই জন্যই বোধহয় সে এ যাত্রা বেঁচে গিয়েছিল।

রজত বলে, আমার আর্জেন্ট কাজ আছে, আমি যাব।
–কোথায় যাবে তুমি! রজতের গায়ে হেলান দিয়ে আরও নিবিড় হয় চন্দ্রা।
–সরুন আমি বাড়ি যাব।
–বাড়ির ছেলে বাড়ি তো যাবেই গো, তার আগে চলো না আমরা খেলা করি দু’জনে!
হেসে টানতে থাকে রজতকে। চন্দ্রা বুঝতে পারে এ ছোকরা একেবারে আনকোরা।

আশপাশের হেঁটে যাওয়া আসা লোকেরা কেউ কেউ ওদের দিকে তাকাচ্ছিল, কেউ কেউ হাসছিল। রজতের কাছে ভীষণ লজ্জাকর ছিলো ব্যাপারটা।
প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে চন্দ্রা রজতকে। পাশে ঝোপের মত জায়গা, মনে হয় কাগজী ফুল গাছের ঝোপ। শুনেছে ওই গাছে কাঁটা থাকে।

দু’কাঁধে হাত রেখে প্রেমিকার মত সুন্দর করে বসিয়ে দিল রজতকে। আর কিছু না বলে সোজা রজতের দু’গালে চুমু খেয়ে দিল। রজত কি বাইরে থেকে শান্ত হয়ে যাচ্ছে? ভিতরে গুপ্ত স্থানে কি তার ধীরে ধীরে সাড়া জেগে উঠছে? না, তেমন হয় নি, ভয়ে সে এখনো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে নি। ওর মনে একটাই চিন্তা, কি করে ওর হাত থেকে রেহাই পাবে!

–দেখ, সময় নেব না, পাঁচ মিনিটে তোমায় শান্ত করে দেব! বলে চন্দ্রা নিজের কোমরে হাত দিল, সামনের দিক থেকে ব্লাউজের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু খুঁজল। না, নেই, নিজের মনেই বলে উঠলো চন্দ্রা, নিশ্চয়ই পড়ে গেছে কোথাও। তার পর কিছু একটা মনে করে চিৎকার করে উঠল, ওই মাগী মেয়েটাকে তাড়াতে গিয়ে শিশিটা পড়ে গেছে কোথাও, হারামজাদী আমার পাঁচ টাকার তেল ফেলে দিল! মুহূর্ত চুপ থেকে রজতের মুখটা টেনে নিজের কাছে নিয়ে চুমু কাটল চন্দ্রা, বুকে-পিঠে হাত রেখে হাতটা ধীরে ধীরে নিম্নাঙ্গের দিকে নিয়ে গিয়ে দু’বার হাত বুলোলো, আর ছোট্ট ছেলেকে বোঝাবার মত করে বলল, আসল কিছু তো এখানে করতে পারবে না, তাই সুন্দর করে একবার আউট করে দেব, কেমন? একটু থেমে আবার বলে উঠল, তবে লক্ষীটি, একটু বসো তুমি, এখনই আসছি। চন্দ্রা ঝট করে তেলের যোগাড়ে চলে গেল।

মাথা চন করে উঠল রজতের, বুদ্ধি খেলে গেল হঠাৎ, কেউ যেন তাকে বলে দিল, পালা, পালা শিগ্‌গীর… ও চারিদিক তাকিয়ে দেখে নিল, চারিদিকে গাড়িঘোড়ার শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছিল না, তবে হ্যাঁ, একদিক থেকে বেশ উজ্জল আলোর আভা আসছিল, সে দিকে তাকাল, অদূরে রাস্তার সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছিল, সারি সারি লাইনে গাড়ি যাতায়াত করছে, আর সময় নেই, ঝোপঝাড়ের ফোকর গলিয়ে ছুটল সে। প্রায় শ’পা ছুটেই পেয়ে গেলো গার্ডেনের সীমানার দেওয়াল, এক কোমর উঁচু ছিলো সেটা, টপকাতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না রজতের। লাফ দিয়ে টপকে সে জনতা আর গাড়ির ভীড়ে মিশে গেল।

সেখান থেকে তেরো নম্বর বাস ধরে সিধা কাকার বাড়ি – পর্ণশ্রীতে পৌঁছে গেল। রজত কাকার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে, এমনি সামার ভেকেশনের সময় প্রতিবারই প্রায় কাকার বাড়ি ঘুরে যায়। কাকু-কাকিমা দু’জনেই তাকে ভালবাসেন, সব সময় তাঁদের কাছে ঘুরে যেতে বলেন। সেইমত এবার রজত এসেছে কাকার বাড়ি, আরও তিন দিন তার থাকার কথা।

গার্ডেনের ব্যাপার তার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। বন্ধুদের কাছে শুনেছে এধরণের ঘটনা বড় বড় শহর-নগরে ঘটে। তবে স্বয়ং প্রত্যক্ষ করার চমক যেন ছিল অন্য রকম! জীবনকে কত অভিজ্ঞতা নিয়েই না এগিয়ে যেতে হয়।

ওই মেয়েটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যে তাকে ওর প্রেমিক হতে বলেছিল। ও হতে চেয়েছিল তার প্রেমিকা, বিনিময়ে বিশ টাকা সে নেবে। দিন-দিন রোজগারের পন্থা কত বিচিত্র ধরণের হয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটি গরীব ছিল সন্দেহ নেই, সংসারে সেই হয়তো একমাত্র রোজগেরে, সত্যি হয়তো তিন-তিনটি পেট ওর রোজগারেই চলে। ও খুব নিরীহ ধরনের ছিল, তবেই তো ওকে মার খেতে হল। আহা, বেচারা বলছিল, দিনভর কিছুই খায়নি! রজতের মন কেমন করে উঠলো।

মেয়েটির চেহারা ছিল ছিমছাম, আবছা আলো-অন্ধকারে তেমন বোঝা যাচ্ছিল না কতটা সুন্দরী দেখতে ছিল। তবে রজত দেখেছে ও মার্জিত ছিল। কথাবার্তায় তো খুব মিষ্টি ছিল তাতে সন্দেহ নেই।

রজত এখন যদি তার দেখা পায় চিনতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, তার গলার মার্জিত সুর এখনো তার মনে গেঁথে আছে। সে যদি তার সামনে এসে কোনো কথা বলে, তার কন্ঠ নিশ্চয় রজত চিনে যাবে।

মন্দ হত না যদি আবার তার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। আর চন্দ্রা, সে কেমন! নিজের মনকে প্রশ্ন করে রজত, ওরে বাবা, সে তো সাংঘাতিক, পারলে গায়ের সব রস সে নিংড়ে নিতে পারে। ভাগ্যক্রমে ওর হাত থেকে বিনা তেলে ফসকে আসতে পেরেছে সে!

রজত ভাবলো, যাবে নাকি আরেকবার ধর্মতলা, শহীদ মিনার, সেই বাগানে, যেখনে রঙচরীরা খেলা করে! এমনই মনের কোণায় লুকোনো ইচ্ছা থেকেই একদিন আবার রজত চলে গেল শহীদ মিনার লাগোয়া সেই বাগানের কাছে। আর, আর কোনো মূল্যবান জিনিস তার সাথে রাখল না, গোনাগুন্তি সামান্য টাকা সঙ্গে রেখে নিল।

শহীদ মিনারের আশপাশে ঘুরতে লাগলো রজত। গার্ডেনের এদিক ওদিক বাইরে লক্ষ্য করতে লাগলো। তখন স্পষ্ট দিবালোক ছিলো, ওই দিনের মত সন্ধ্যের কাছাকাছি সময় নয়, জোড়ে জোড়ে ছেলে মেয়েরা বাগানে ঢুকছে, বের হচ্ছে। এর মধ্যে কি আছে সেই মেয়েটি যে তাকে বলেছিল অজয়দার অভিনয় করতে!

রজত লক্ষ্য করে দেখল, গার্ডেনের এক কোণায়, বাইরের দিকে দেওয়ালে হেলান দিয়ে এক মহিলা এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কে জানে, ওদিনের মেয়েটি হবে কি না? রজত তাকালো মহিলার দিকে, না, সে চোখ সরিয়ে নিল, রজতের দিকে চাইবার উৎসাহ দেখাল না। তার মানে, এ মহিলা সেই মেয়ে হতে পারে না। আর এক জায়গায় রজত খেয়াল করল, বাগানের বাইরে, গেটের একদিক থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, মনে হল গার্ডেনের ভেতরে যেতে তার ইচ্ছা নেই। চেহারা-আকৃতিতে মনে হলো সে হলেও হতে পারে। রজত আরও কাছে গেল তার, মেয়েটির থেকে হাত-দশেকের মত দূরত্ব নিয়ে দাঁড়াল। বাইরের দিকে মেয়েটি কম তাকাচ্ছে। গার্ডেনের ভিতরের দিকে যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, অথচ ভেতরে ঢুকছে না। তবে কি ভেতরে ঢুকতে সে ভয় পাচ্ছে! রজত ভেবে নিল, এই সে হতে পারে, চন্দ্রা আর তার সাথের গণিকা মেয়েটিকে তার ভয়, আবার যদি তারা গলাধাক্কা দিয়ে, চুলের মুঠি ধরে বাগান থেকে তাকে বের করে দেয়! এমনি সময় মেয়েটি রজতকে লক্ষ্য করল, তারপর দু’তিনবার তাকাল, তৃতীয়বার চোখাচোখি হতে রজত সাহসে ভর করে এক পা দু’পা করে ওর দিকে এগোতে থাকল। অনেক কাছে এগিয়ে গেল রজত, মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

মেয়েটি মৃদু হাসল রজতের দিকে তাকিয়ে, তারপর বলল, কাকে খুঁজছেন আপনি?
কি বলবে রজত একটু সময় চুপ থেকে ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ, মানে – আপনিও কি কাউকে খুঁজছেন?
মিষ্টি হেসে ও বলল, হ্যাঁ, কোনো বন্ধুকে।
রজতের এবার খেয়াল হলো, হ্যাঁ, এ কণ্ঠ তার পরিচিত মনে হচ্ছে! ও সাহস ভরে বলে উঠল, আচ্ছা আপনার সঙ্গে কি আমার গত পরশুদিন আলাপ হয়েছিল?
–আপনার সঙ্গে! বলে ও কিছু সময় চিন্তা করল।
–হ্যাঁ, আমার নাম অজয়, অজয়দা, নামটা আপনি দিয়ে ছিলেন, রজতের বদ্ধ ধারণা এ সে না হয়ে পারে না – মেয়েটি তার রোজকার নাটকের মাঝখান থেকে অজয়দার নাটকের সংলাপ স্মরণ করে উঠতে পারছে না, আরও পরিষ্কার ভাবে মনে করিয়ে দেবার জন্য বলে উঠে রজত, আপনাকেই তো দু’টো মেয়ে গার্ডেন থেকে বার করে দিয়েছিল!
এবার মাথা নাড়ল মেয়েটি, আচ্ছা আপনি ছিলেন সে দিন! সেই বোকা বোকা কম কথা বলা ছেলেটা! মেয়েটি এবার প্রাঞ্জল হাসল, রজতের আরও একটু কাছে এসে দাঁড়াল।

নিজেকে সংযত করতে পারলনা রজত, বলে ফেলল, চলুন না, গার্ডেনে ঘুরে আসি একটু সময়।
মেয়েটির মুখে ভয়ের ছায়া পড়ল, না, গার্ডেনে না, চলুন আমরা গার্ডেনের বাইরে, রাস্তা দিয়ে হাঁটি।

কেন যেন রজতের ওকে আজ বড় আপন বলে মনে হচ্ছে, আপনার নাম জানতে পারি?
–নাম! বলে, ইতস্তত করে বলল, রুপালী।
–না, আপনার নাম রুপালী বলে মনে হয় না।
–কেন?
–আপনাদের তো হাজারটা নাম, রজত বড় স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে চলেছে।
–কিছু ভেবে নিয়ে মেয়েটি বলল, অরুণা, সত্যি আমার নাম অরুণা, আর আপনার নাম?
–অজয়, রজত চট করে উত্তর দেয়।
–বা, আপনিও বানানো নাম বলে দিলেন! অবশ্য বলার ইচ্ছে না থাকলে থাক, বলতে হবে না, আমি না হয় অজয়দা বলেই ডাকব।
–থাকো কোথায় তুমি? রজত নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, সে কখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে! তবু সামলে নেবার চেষ্টা করল, সরি, তুমি বলে ফেললাম!
–ভালো লাগছে, আমিও অভিনয়ে না হয় আপনাকে তুমি ডাকব, বুঝেছ! কেমন চোখকে প্রেমিকার মত ঈষৎ নাচিয়ে উঠলো অরুণা।
–ঠিক আছে, কোনো আপত্তি নেই, হেসে বলে রজত।
রজত থামল এক জায়গায়, দু ঠোঙা ঝালমুড়ি কিনে নিল। অরুণার হাতে এক ঠোঙা দিয়ে, নিজে একটা নিয়ে প্রেমালাপ করতে করতে ওরা হেঁটে চলল বেশ সময় ধরে। আস্তে আস্তে রাত বাড়তে লাগলো, অরুণার হয়তো ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।
–অরুণা, ঘরে ফেরার তোমার সময় হল, না?
–হ্যাঁ, রাত হয়ে গেল।
–তুমি কোথায় যাবে অরুণা, মানে তোমার ঘর কোন দিকে?
–আমাদের লাইনে, কিছুই সত্যি বলতে নেই, তবে অজয়দা, আমি সত্যি বলছি তোমায়, আমি চাঁদনী মার্কেটের দিকে থাকি, এখান থেকে কাছেই, একটা বস্তী বাড়িতে।
–আমি বেহালা, পর্ণশ্রী থাকি, কাকার বাড়ি, বেহালা কলেজের পাশেই।
অরুণা কিছু ভেবে নিয়ে বলল, তা হলে বিদায় নিতে হয়!
–হ্যাঁ, চল আমরা বাড়ি ফিরি। পকেটে হাত ঢুকালো রজত, পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করল, দেবার জন্য অরুণার দিকে হাত বাড়ালো।
অরুণা কি ভেবে থমকে দাঁড়াল, রজতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আজ নয় অজয়দা, অন্য একদিন। আজ তো সত্যিকারের বন্ধু হয়ে ঘুরলাম, আমার অভিনয় আজ অভিনয় হয়ে উঠতে পারেনি।
–তা হয় না অরুণা, তোমার সংসার আছে, হয়তো স্বামী ছেলে মেয়ে…
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল রজত। মাঝখানে অরুণা বলে উঠলো, না, অজয়দা আমি অবিবাহিতা, আমার মা আছে, এক ছোট ভাই আছে, মা আমার বিছানায় শয্যাশায়ী…
–তোমার টাকার খুব প্রয়োজন অরুণা, রাখ এটা, রজত আবার এগিয়ে ধরে টাকাটা অরুণার সামনে।
–না, অজয়দা আজ নয়, আজ তোমার কাছ থেকে কিছুতেই টাকা নিতে পারব না।
–আবার কবে দেখা হবে অরুণা?
–মন থেকে চাইলে কোথাও না কোথাও কখনো না কখনও ঠিক দেখা হয়ে যাবে অজয়দা!
উভয়ের নীরবতায় কেটে গেল কিছু সময়।
–আমি আসি, বলে অরুণা কয়েক মুহূর্ত রজতের দিকে তাকিয়ে থাকল, মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার, ঘরে ফেরার তাগিদে এগিয়ে গেল রাস্তা ধরে, আর পরক্ষণেই ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

রজত দেখেছিল, অরুণার চোখের কোণদুটি জলের আভায় চকচক করছিল, কেন যেন মনে হয়েছিল নিজের আসল নামটা অরুণাকে বলে দেয় সে। সময় আর সুযোগের অভাবে তা আর বলা হল না।

তারপর বহু বছর কেটে গেছে, রজতের মনে আজও সে কথা স্মৃতি হয়ে থেকে গেছে।