আমার অফিস-এর নাম ছিল কাশী ইনফোকম। নামটা কেমন একটা অস্বস্তিকর। কোথায় কাশী, এক ধর্মস্থান, আর কোথায় ইনফোকম – এ যেন দুই মেরুর মিলন! স্মৃতির বেড়াজালে অনেক কিছুই জড়িয়ে রয়েছে; সেই অফিস একমোডেশন – দশ-বারো’টি ছেলের একসাথে ফ্ল্যাটে থাকা, দিনে একদল আর রাতে আরেকদল; কলসেন্টার মাপের অফিস, খোলা তিনশো পঁয়শট্টি দিন, চব্বিশ ঘন্টা; আমার কাজ শুরু হত রাতে, তাই টানা ছ-মাস রাতজাগা দিনগুলো, আরও কত কি।
কাশী ইনফোকম-এর প্রীতম – সকলে ছোটো করে ডাকত, প্রীত – ছিল একটু মোটাসোটা, গাব্দা-গোব্দা, লম্বা-চওড়া, হাসি-খুশি একটি ছেলে। প্রথম আলাপেই সকলকে আপন করে নেয়। আমার সাথে পরিচয়টাও ভারী অদ্ভুত। ছেলেটি কাজ করত সিস্টেমস-এ, অর্থাৎ আমাদের সকলকে টেক্-সাপোর্ট দেওয়া ওর কাজ। এক রাত্তিরে হঠাৎ-ই আমার কাছে এসে হাত বাড়ায়। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় হাত বাড়াতে গিয়ে দেখি এক বিচিত্র ভঙ্গিমায় হাতটিকে ওপর দিকে তোলে – যেন আমার দিকে হাত মেলানোর জন্য বাড়ায়ইনি। অপ্রস্তুত হয়ে হাতটা নামাতেই জড়িয়ে ধরে। নিমেষের মধ্যে আমার সব জড়তা, বাধা কোথায় উধাও হয়ে যায়।
আমার পাশে বসত একটি শান্ত-শিষ্ট কেরালিয়ান ছেলে। সে হেসে বলে – হি ইস লাইক দ্যাট ওনলি, বাট ভেরি পিয়র অফ হার্ট। সত্যিই ওর হাসির নির্মলতা সব গ্লানি মুছিয়ে দিত।
এ অফিসে আরোও কিছু চরিত্র ছিল যা আমায় খুব টানত। তারমধ্যে বিশেষ নজর কাড়ত ভীষণ শান্ত, কম কথা বলা, লাজুক এক যুবক। সারাদিনই যেন অন্য দুনিয়াই বাস করছে। সে ছিল সকলের জীতুয়া। জীতেন্দর থেকে জীতুয়া কখন হয়ে গেছিল তা সে নিজেও বোধকরি জানেনা। এই ছেলেটির সাথে প্রীত-এর সম্পর্কটা ছিল দেখার মত – সারা রাত্তির প্রীত ওর পিছনে কাঠি করছে, অথচ ভীষণ শান্তভাবে জীতুয়া তা সামাল দিচ্ছে।
একদিনের কথাই ধরা যাক – রাত্তিরে টি-ব্রেক। সকলেই অফিসের বাইরে ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাড়িয়েছে। জমেছে আড্ডা। প্রীত প্রতিদিনের মতই ফুল ফর্ম-এ। কেউ বসেছে সিঁড়িতে, কেউ বা বাইকের ওপর। জীতুয়া চায়ের কাপটি নিয়ে এসে দাঁড়ায়। নিমেষের মধ্যে প্রীত ও আরেকটি ছেলের দৃষ্টিবিনিময় হয় যা আমার চোখ এড়ায়নি। জীতুয়া যেই একটি সিগারেট পকেট থেকে বার করে প্রীত ভাল মুখ করে বলে – ছোড় না তেরা ওহ্ ছোটা সিগ্রেট; বড়া সিগ্রেট পী।
কিছু না ভেবেই হাত বাড়ায় জীতুয়া। খানিকবাদে শুরু হয় কাশি। কেউই ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি শুধু দুজন ছাড়া; অবশ্য আরো একজন উপলব্ধি করেছিল নীরবে। পরে প্রীতকে চেপে ধরাতে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। সিগারেটের ফিল্টারটি খুলে গুঁড়োলঙ্কার মশলা সামান্য একটু মিশিয়ে ছিল। যাইহোক, এইসব হাসি-মজা, দুষ্টুমি ও কাজ নিয়েই সকলের কাজের রাতগুলি কাটছিল।
এই অফিসের বিশেষ একটি দিক – মাসকাবারি বেতনের কোনও নির্দিষ্ট দিন ছিল না; প্রতি মাসই প্রায় একমাস পেছনে চলত। সে সময়ে রাত্তিরের অফিস হোত দেখার মত। এ বলে কাজ করব না, ও বলে কাজ করব না। চারিদিকে একটা বিদ্রোহের ছায়া। মাঝেমাঝে মনে হোত এত অসুবিধে নিয়ে মানুষগুলো এ জায়গায় পড়ে থাকে কেন। একান্তে সকলের সাথে কথা বলে বুঝেছি – ওখানে তাদেরই স্থান যাদের আর কোনও পথ নেই; প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বাধা আছে, যা তাদেরকে পরবর্তী গন্তব্যর দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে আটকে রেখেছে। আরেক প্রজাতির জীবও ওখানে কাজ করে, যা দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে – যাদের কাজ না করে গল্প করাটাই কাজ। প্রথমে একটু অবাক হয়ে ভাবতাম – এত বড় অফিস, বড় এস্টাব্লিশমেন্ট – কি করে চলছে?
সাতপাঁচ চিন্তা-ভাবনা নিয়েই আমার অফিস-জীবন যথারীতি এগিয়ে চলে; বাড়ে প্রীতমের সাথে ঘনিষ্ঠতাও। এক রাত্তিরে কাজে বসেছি, হঠাৎ প্রীত এসে হাজির। কিছু না বলে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে যায় ওর রুমে। দেখি আরও চারজন সিস্টেমস্-এ বসে। রুম-এর মধ্যে মেশিনের শব্দ, চারিদিকে ছড়ানো-ছেটানো অগোছাল ভাবটা দেখে বিরক্ত হয়েই বলি – কেয়া হুয়া?
ভালভাবে খেয়াল করে দেখি, যেন এক উগ্র উদ্যম কাজ করে চলেছে ওদের ক’জনের ভিতর। প্রীত উঠে একটা প্যাকেট নিয়ে আসে, খুলে টেবিলের ওপর রাখে। কয়েকটি পাঁচশো ও একশো টাকার মেশানো বান্ডিল। কিছু না বুঝে প্রীত-এর দিকে নজর পড়তেই বলে – দাদা, পঁচাস হজার হ্যায়। কুছ ধন্দা বতাও না।
মুখ দিয়ে হঠাৎই বেরিয়ে যায় – মচ্ছিকা ধন্দা করো। আর একটাও বাক্য বিনিময় না করে পা বাড়াই।
এরপর কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। প্রত্যেকদিনই রাত্রে অফিস করি আর সকাল হলে ফিরে যাই নিজের ডেরায়। ওদের দিকে চোখ পড়ে কিন্তু কিছু বলি না। চারজনের চোখের দিকে তাকালে এক উদ্দীপনা নজরে পড়ে। অযথা কৌতূহলী হওয়া আমার স্বভাববিরুদ্ধ বলে প্রশ্ন করি না।
প্রায় মাসখানেক পর প্রীত একদিন ডাক দেয় – দাদা। স্নেহবশতই চেয়ার টেনে বসতে বলি। উদ্দেশ্য একটাই, সেদিনের ঘটনার পিছনে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।
প্রীত না বসে পাল্টা বলে – কল সুবহ আপসে কাম হ্যায়। আপকো চলনা হোগা মেরে সাথ।
চোখটা একটু বড় করি প্রশ্নাত্মক ভঙ্গীতে। উত্তর না দিয়ে একটু হেসে প্রীত চলে যায়। ওর হাঁটার ভঙ্গির মধ্যে তফাত ধরা পড়ে।
পরদিন দুপুর বারোটায় প্রীত হাজির। এসেই শুরু হল পুরোন প্রীত-এর হাসি-মজা। ভারি ভাল লাগল ওর হাসি-খুশি নির্মল মুখটা। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরোই ওর সাথে। বেশ কিছুটা এসে বুঝি আমরা ঢুকছি কোন এক অফিস পাড়ায়, বাইকটা সোজা এনে দাঁড় করায় এক মাঝারি মাপের ভ্যানের সামনে। তখনও বুঝিনি আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে এক চমক, ভ্যানটির পিছনেই। এগিয়ে দেখি অধীর অপেক্ষায় রয়েছে বাকিরা। অবাক কাণ্ড! চারজনে মিলে খুলেছে মোবাইল ফিশ শপ। নামটাও ভারী সুন্দর – কাশী’স্।
শুরু হোল আমার প্রশ্নের পর প্রশ্ন। শেষে বুঝলাম, প্রায় বিরক্ত হয়ে বলা কথাটায় গুরুত্ব দিয়ে, ওরা খুলেছে মাছের দোকান। গাড়িটা নিয়েছে ভাড়ায়। শিশুর মত আগ্রহে সব দেখছিলাম। সুন্দর ডেকোরেট করে রাখা মাছের বিভিন্ন প্রিপারেশন। কাস্টমার এলেই তৎক্ষণাৎ রেডি করে সার্ভ। দিনের শেষে সব দেওয়া-নেওয়ার পর থাকে প্রায় হাজার খানেক টাকা। প্রীত বলে – কেয়া দাদা, ঠিক হ্যায় না?
উত্তর দেওয়ার ভাষা সে মুহূর্তে আর ছিল না। শুধু বুঝলাম, কিছু করার তাগিদ ওদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সত্যিই এ জগৎ সংসারের রহস্য বোঝা ভার। কখন কোথায় তা বাঁক নেয় কেউ জানেনা।
প্রশ্ন করি – রাতকা অফিস?
উত্তর আসে – দো দো করকে সমহালতে হ্যায়। এক কথায় মনের সব দ্বিধা কেটে যায়। বিশ্বাস আসে ওদের ওপর। খুশি মনে বিদায় নিই ওদের কাছ থেকে।
সময় তার নিজস্ব নিয়মেই এগিয়ে চলে। এগিয়ে চলে প্রীতদের ব্যবসা ও আমার অফিস জীবনও। অগোছালো কাশী ইনফোকম-এর জীবন থেকে বেরিয়ে নতুন অফিসে জয়েন করেছি; কেটে গেছে প্রায় বছরখানেক, হয়েছি আরও ব্যস্ত, থাকার জায়গারও পরিবর্তন হয়েছে। কর্মব্যস্ততার মাঝে প্রায় ভুলতেই বসেছি ওদের কথা। একদিন নতুন ফ্ল্যাট-এ ঢোকার মুখে দেখি প্রীত দাঁড়িয়ে। তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে ওপরে যাই। চেহারা দেখে তো মনে হয় ভালই আছে। ফ্ল্যাটে ঢুকে শুরু হয় নানা কথা।
শেষে প্রীত জানায় তার আসার উদ্দেশ্য। ব্যাপারটা শুনে বুঝি প্রীত-এর ভেতরটা রয়েছে একই রকম। ওরা চারজন অফিস ছেড়ে দিয়েছে। ঐ অফিস থেকেই জোগাড় করেছে আরও দশটি ছেলে। শুরু হয়েছে আরও চারটে মোবাইল ফিশ শপ্। একটি নতুন দোকান কিনেছে, শুরু হচ্ছে একটি স্থায়ী কাউন্টার। তারই নিমন্ত্রণ নিয়ে হাজির প্রীত।
মোবাইল ফিশ শপ্-এর ধার ও ভার বাড়া নিয়ে কোনও সন্দেহ রইল না আর। প্রীত জানায়, জীতুয়া যোগ দেওয়ার পর থেকে ব্যবসার অনেক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। একে একে এসেছে সবাই। কাউকেই জোর করে আনা হয়নি। স্বেচ্ছায় শ্রম ও অর্থের জোগানে এগিয়ে চলেছে কাশী’স্।
কথার মাঝেখানেই ওকে থামাই, বলি – বিয়েটা?
এবার প্রীত লজ্জা পেয়ে যায়। অনেক চাপাচাপির পর একটি মেয়ের কথা বলে, নাম – নেহা। নামটা শুনে চোখটা একটু ছোট হতেই প্রীত হেসে বলে – হাঁ… হাঁ দাদা, যো আপ সোচ রহে হো, ওহি সচ হ্যায়। হমারি অফিস কি নেহা। য়ে সব উনহি কি চক্কর হ্যায়।
নেহা-ই নাকি জোর করে প্রীতকে আমার সাথে কথা বলতে বলে। আর আমার উত্তর শোনার পর বলেছিল – ওহি সহি, শুরু তো কর্।
প্রীত-এর কথা আর যেন প্রায় কিছুই কানে যাচ্ছে না; শুধু মনে পড়ছে অফিসের সেই প্রথম দিনটি। মেজনাইন ফ্লোর-এ এডমিন্-এর অফিস। অফিসের জয়েনিং-এর সব কাগজপত্রের কাজ সেরে বসে আছি এম.ডি.’র সাথে দেখা করব বলে। চুপ করে বসে দেখছি সকলকে। বার বার চোখ যাচ্ছে দূরে বসে থাকা কর্মরতা মেয়েটির দিকে। মাঝারি মাপের চেহারা, স্টেপকাট চুল, নীল জিনস্, ও গোলাপী ঘাঘরার মত টপটিতে লাগছে বেশ। নিজের খেয়ালে আমার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো কম্পিউটারে এন্ট্রি করে চলেছে। টেবিলের ঠিক ওপরেই এ.সি.-র ডাক্টটা থাকায় চুলগুলো হাওয়ায় একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি চেয়ার ঘুরিয়ে আমার দিকে ফেরে – দাদা, আপকা কোয়ালিফিকেশন কে সাথ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ফিট নেহি হ্যায়।
মুঁচকি হেসে বলি- কিঁউ?
পালটা হেসে, পেনটা ঠোঁটে লাগিয়ে এক গভীর দৃষ্টি নিয়ে বলে – পতা নেহি।
চোখের সামনে হাত নাড়া দেখে হুঁস ফেরে। প্রীত বলে – পর্দার আড়ালে সেই ব্যবসার পরামর্শদাত্রী।
সময় গড়িয়েছে। স্থায়ী দোকানের উদ্বোধনে গেছি। যোগাযোগগুলো আরও বেড়েছে। বেড়েছে প্রীত-এর যাতায়াতও। একদিন অফিসে হাজির। পিক্ আপ করে নিয়ে যায় সেই পুরোনো অফিস পাড়ায়। চা-এর দোকানের সামনে বাইকটা দাঁড় করিয়ে বলে – এক রিকোয়েষ্ট থা।
- ক্যায়া?
- মেরা এক দোস্তকো ধন্দা করনা হ্যায়। আপ বোল দিজিয়ে না কৈসে শুরু করেঁ।
আমি কিছুতেই প্রীতকে বোঝাতে পারিনা যে ওটা না ভেবে বলা কথা। খানিক প্রায় জোর করেই বন্ধুকে এনে হাজির করে আমার কাছে। সেই শুরু…
আরবসাগরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক ঝড়। পেরিয়েছে প্রায় দশ বছর। প্রীত-দের ব্যবসা বেড়ে এখন অনেকটাই বড়। পুরো মুম্বাই জুড়ে ফিশ শপ্-এর চেইন। তৈরি হয়েছে ব্র্যান্ড। নাম রয়ে গেছে সেই কাশী’স্।
আর আমার?
করতে এসেছিলাম চাকরি, প্রীত-এর বন্ধুদের সাহায্য করতে করতে কখন হয়ে গেছি বিজনেস্ কনসালটেন্ট, তা নিজেও টের পাই নি।
0 কমেন্ট:
Post a Comment
@123kobita: