হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

 

মাথায় হেনা লাগিয়ে বসেছিল মৈথেলি। আজকে উইক অফ। এই উইক অফ’টাতেই ও একটু রূপচর্চা করে। রূপচর্চা মানে একটু চুলের যত্ন, একটু মুখের ত্বক দেখাশুনো, একটু নখ শেপ করা। এমনিতে তো সময় হয় না। টেকনোপলিসের ব্যাক অফিসে আছে ও। বিরাট ওয়ার্ক লোড। শুধু অফিসে কাজ করলেই হয় না। ল্যাপটপ-এ বাড়িতে বসেও অনেক কাজ আপডেট করতে হয়। এদিকে বাড়িতে বাবা শয্যাশায়ী। জোর করে কোম্পানি থেকে ভলান্টারী রিটায়ারমেন্ট করিয়ে দেবার আঘাতটা মেনে নিতে না পারায় একটা সেরিব্রাল এ্যটাক বাবাকে বিছানায় ফেলে দিয়েছে। আজ মৈথেলির মা’কে গোটা ভেতরটা আর ওকে বাইরেটা সামলাতে হয়। যে টাকা বাবা পেয়েছে, তা ব্যাঙ্কে ফিক্সড করলেও তো ভিক্ষা। তাই মৈথেলি’কে বাবা’র অমত সত্ত্বেও বাড়ি থেকে বেরোতে হয়েছে। ও অফিসে বেরিয়ে যায় সকাল সাতটায়। তারপর থেকে সে-ই মা। সংসার সামলায়, বাবাকে সামলায়, কিন্তু মুখে রা-টি কাটে না। মানুষ যে নিতান্ত আপনজনকেও শুশ্রূষা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তা যেন মা’কে দেখে বুঝতে পারে মৈথেলি। ক্লান্ত হয়ে মেয়ে বাড়ি ফেরে, তাকেও দেখতে হয় সেই মা’কেই। মৈথেলির কিছু করারও নেই। অনেকবার ভেবেছে, চাকরীটা ছেড়ে মা’র পাশে থাকবে। তবে মা একটু সঙ্গী পায়। মা-টা আর পারেনা এই বয়সে। কিন্তু ভয় হয়। এ্যাতোগুলো টাকা মাইনে! মা’র যদি কিছু হয়ে যায়, তবে অন্তত বাড়িতে কাজের লোক, নার্স বা অন্য কোন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে গেলে টাকা চাই। বাবার জমানো টাকাতে সারা জীবনটা চলবে না, চলতে পারে না। তাই বিয়ে-টিয়ে করার কথা ভাবতে পারে না মৈথেলি। একগাদা রূপ নিয়েও মৈথেলি আইবুড়ি। অবশ্য ওর হাবভাব দেখে কোন ছেলে ওর আইবুড়িত্ব ঘোচাতে ধারে-কাছে ঘেঁষে না। ঘেঁষাই সার হবে। ঘেঁষাঘেঁষি তো হবে না। হতে পারে না। বাবা বা মা ছেড়ে ওর পক্ষে চলে যাওয়া সম্ভব নয়।

মৈথেলি কালকেও রাত তিনটে পর্যন্ত ল্যাপটপ-এ কাজ করেছে। মনে মনে ভেবেছে, কাল তো উইক অফ। বেশ করে স্নান-টান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে নেবে ঘণ্টা বারো। তাই-ই করে ও। কিন্তু…। ভাবলেই তো হয় না। ভাগ্য চাই। ঘুম তো হলই না, মা’কে নিয়ে বেরোতে হোল। বাবা বলল,
- যা না, মা’কে একটু রেখেই আয় না। সারাটা দিন না হয় এখানে সাধনা থাকবে। অবশ্য না থাকলেও তেমন কিছু হবে না। রান্না তো করেই যাবি। আমি তো চলতে-টলতে পারি, না কি! ম্যানেজ করে নেব’খন।
- তুমি বেশি পাকামো করো না তো। চুপ করে চা-টা খাও। আমরা বড়রা বুঝবো, কী করতে হবে।

মেয়ের রসিকতায় বাবা চুপ করে। বাবার শরীরটা এমন খারাপ হওয়া ইস্তক মেয়ে এমনটাই বলে। এটুকুই তো জীবন। মেয়ে আর তার মায়ের সাথে একটু রঙ্গ-রসিকতা। এটা তো ছাড়া যায় না। মেয়ে-ও তাই শিখেছে। ‘আমরা বড়রা’ মানে মেয়ে, ও নিজে, ওর মা আর কাজের লোক সাধনা। মাঝে মাঝে সাধনাকে বললে সন্ধ্যে পর্যন্ত সে এ বাড়িতে কাটিয়ে দেয়। অন্তত টিভি-টা তো দেখতে পারে প্রাণ ঢেলে। সেই প্রস্তাব-টাই বাবা দিয়েছে। কিন্তু মেয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে। অবশ্য পরে সেই প্রস্তাবটাই মানতে হোল ওদেরকে। তবে একটু অধিকন্তু চাপিয়ে নিয়ে। মা যে-কটা দিন বড়মামার বাড়িতে থাকবে, ততদিন দু’বেলাই খাবার আসবে হোম ডেলিভারি থেকে। আর সে-ই সাধনা অন্য কাজ সেরে-টেরে এ বাড়িতে সন্ধ্যে পর্যন্ত কাটাবে। ওর খাওয়াটাও আসবে হোম ডেলিভারি থেকে। মৈথেলি ফিরে আসে সন্ধ্যে সাত-টার মধ্যে। তখন সাধনা চলে যাবে। ক’টা মাত্র দিন। মা ফিরে এলেই সাধনা যেমন কাজ করে চলে যায়, তেমনই যাবে।

মা’কে যেতেই হচ্ছে বড়মামার বাড়ি। বাবা-ই জোর করল। সত্যি-ই তো। যাওয়া তো উচিত। দিদুনের বয়স হয়েছে। তার ওপর এটা থার্ড-বার এ্যাটাক। যদি সারভাইভ না করে? তবে মা’র মনে একটা খিঁচ সারা জীবনের জন্যে ধরে থাকবে। তাছাড়া একটা মানসিক উচাটন নিয়ে তো কাজও করা যায় না। নানা ভুলভাল হবে, চোখের জল ফেলবে, বাবা নিজেকে অপরাধী মনে ক’রবে। তাই বাবা-ই বলল,
- যা না। মা’কে রেখে আয় না। তুই তো আছিস। কী আর হবে!

মৈথেলি জানে, মা’র বিরাট দুর্বলতা মা’র বাপের বাড়ি। সেখানে কারোর এ্যাতোটুকু কিছু হলে মা অস্থির দারুণ হয়। বাবা-ও জানে। তাই এ্যাতো কথা বাবা বলছে।
মাথায় হেনা মেখে বসেছিল তো এসব জানার আগে। ল্যাপটপ ছিল ল্যাপ-এ। ন-আঙুল চলছিলো ঝড়ের বেগে। কাল রাতে পুরোটা সারতে পারেনি। একটু বাকি ছিল। সেটাকে সবে কমপ্লিট করেছে, বেজে উঠলো ‘আমার রাত পোহালো…’। এটা মৈথেলির রিং-টোন। কানে ধরতেই, বড়মামা।

- মিতু, তোর মা কোথায় রে?
- কেন, বড়মামা?
- আস্তে কথা বল। মা কোথায়?
- মা তো কিচেনে। কেন? বলো না।
- আরে, বলবো বলেই তো ফোনটা করলাম। কিন্তু দিদিকে বলা যাবে না।
ফিসফিস করে মৈথেলি বলে, ‘কী হয়েছে গো, বড়মামা? দিদুন ক্যামন আছে? ভালো তো?’
- না। সকালে একটা এ্যাটাক হয়েছে। তাই তোকে জানালাম। তোর মা’কে বললে তো জানিস…। তুই তো এখন বেরোবি অফিসে। ফেরার পথে একবার ঘুরে যাস। তা হলেই হবে। তোর মা’র কাছে দোষ কেটে যাবে।
- না। আমার তো আজ উইক অফ। কিন্তু বড়মামা, মা’কে আদৌ না বলাটা কী ভালো হবে? তার মা বলে কথা। তুমি তো জানো সবই। আমি দেখছি, কী করা যায়।
- দ্যাখ, যেটা ভালো বুঝিস। কিন্তু সাবধানে।
- দিদুন কোথায় এখন? নার্সিংহোম-এ কি?
- হ্যাঁ।
- তুমি ভেবো না। দেখছি, কোনটা সুবিধে হয়।

ফোনটা কেটে মনে মনে একটা গৎ আওড়ে নেয় মৈথেলি। মা’কে কী ব’লবে, কেমন কায়দায় বলবে। এই কারণেই বাড়িতে গোটা সিস্টেম পালটে ফেলতে হোল। মা কিন্তু সব শুনে-টুনে তেমন কোন রি-এ্যাকশন দেখালো না। শুধু তার যাওয়া পাকা হতে একবার মেয়েকে বলল,
- তুই অফিস সামলে এসব পারবি?
কিন্তু মেয়ের চোখ পাকানোতে মা-ও চুপ করে যায় বাবার মতো।

মা’কে নিয়ে বেরিয়েছে মৈথেলি। তিনটে বেজে গেলো। বাবার খাবার ব্যবস্থাটা করে বাবাকে খাইয়ে-দাইয়ে উঠেছিলো। কিন্তু সাধনা তো তার কাজকর্ম সেরে আসবে। ও না এলে যাওয়া চলে না। এমনকি ও রাজি না হলে আদৌ মা’র যাওয়া হতো না হয়তো। স্টেশনের কাছেই মৈথেলিদের বাড়ি। বড়মামার বাড়ি যেতে ট্রেন ধরতে হয়, শিয়ালদায় নেমে বাস। স্টপেজে নেমে মিনিট ছয়েক হেঁটে বড়মামার বাড়ি। ও অফিস যায় বাস-এ। সোজা এক বাসেই অফিস। নো ঝুট, নে ঝামেলা। এক ঘণ্টার জার্নি। বসার সীট-টিট জুটে যায়। টারমিনাস ওদের বাড়ির সামনেই। ফলে ট্রেনে ওঠা একটা বিরাট বিরক্তিকর ব্যাপার মনে করে মৈথেলি। সেই ভিড়, ঠেসাঠেসি, গাদাগাদি, গায়ের দুর্গন্ধ। এসব বালাই নেই ওর বাসে। যারাই বাসটায় ওঠে, তাদের পকেটে রেস্ত আছে। ভাড়া বেশি। শিয়ালদা থেকে বাস মানে লক্কর-ঝক্কর। চৌতিরিশ-এর বি… না যেন কত! মাই গড! আজকে মারাই যাবে টেকনোপলিসের একজিকিউটিভ ম্যাডাম মিত্র। মামার বাড়ির সামনে যে রাস্তা, সেটা তো দুঃস্বপ্নের মতো। দোকান-ফোকান কিছু নেই। শুধু গাদা গাদা হকার ফুটপাথ দখল করে বসে আছে। প্লাস্টিক টাঙ্গিয়ে, উনুন জ্বালিয়ে, যমের মতো মাছ কাটার বঁটি খাড়া করে… সে এক যা তা কাণ্ড। হাঁটার কোন কায়দা নেই। কোনরকমে শরীর একিঁয়ে-বেঁকিয়ে পেরোতে হবে পথটা। বড়মামারা ভাড়া থাকে। বাড়িটা প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। দাদুর বাবা ভাড়া নিয়েছিলেন। ভাড়া ছিল তেরো টাকা। মালিক অনেক দয়া ভিক্ষা চাইবার পর আজ তা হয়েছে সাকুল্যে একশো বারো টাকা। আজকাল মালিক ভাড়া নিতে আসেওনা। তার তো গাড়ি ভাড়াও পোষাবে না। সাকুল্যে তিনটে ঘর। কিন্তু স্যাতলা পড়া ছাল ওঠা দেওয়াল, রহস্যময় কড়ি-বড়গার ছাদ। মনে হয়, জোব চারণক-এর আমলের কোন বাড়িতে এসে উঠেছি। কিন্তু যেতে হবে। একটাও কিল খেতে না চাইলেও কেউ যদি ধরে কিল মারে, তবে যে কটা মেরে পারে, তা খেতে হবে। কিচ্ছু করার নেই। আজ অন্তত বছর ঘুরে গেছে, বড়মামার বাড়িতে যায়নি মৈথেলি।

ট্যাক্সি নেয়ার ক্ষমতা নেই মৈথেলির, তা নয়। কিন্তু ফাঁকা লোকাল ট্রেনটা দাঁড়ানো দেখতে পেয়েই মনে হলো, টাকাটা বাঁচানো যাক। তাহলে মামার হাতে আরো কিছু বেশি টাকা দেওয়া যাবে। তাই টিকিটটা কেটে ট্রেনে উঠেছে। শুরুতে তেমন ভিড়-টিড় ছিল না। কিন্তু দুটো স্টেশন যেতে না যেতে পিলপিল করে মানুষ ছুটে এসে ট্রেনের দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। বেলা বাজে তিনটে। এ্যাতো বেলায় এরা সব যায়টা কোথায়! একটু বাড়িতে কি তিষ্ঠোতে পারে না! কী মানুষ রে বাবা! এদের সবার তো বিপদ ঘটেনি। দরজার সামনে একটা ফলওয়ালা তার ঝাঁকাটা ঘটের মতো বসিয়ে রেখেছে আর নিজে কয়েকটা ফল হাতে নিয়ে ভেতরে ডেমো দিতে গেছে। কীভাবে মানুষ উঠবে গাড়িতে! ওর মা না হয় ভেতরে ঢুকে গেছে। শিয়ালদায় নামতে কোন প্রবলেম হবে না। কিন্তু একটা জিনিস অবাক হয়ে দেখছে মৈথেলি… কেউ তেমন ভ্রূক্ষেপ করছে না। কেউ কিছু বলছে না। তারপর শুরু হোল বাদাম, দাদ, হাঁজা, চুলকানি, লেবু লজেন্স, পেয়ারা, আপেল… মানে হরেকরকম্বা। এবার এলো সারা গায়ে মোবাইল কভার থেকে শুরু করে সেফটিপিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে বিক্রী। তার গা-এ কী আছে, আর কী নেই! তারপর তাদের গা জ্বালানো কণ্ঠে আর কায়দায় হকিং। একেকজন একেকরকম। কী বিরক্তিকর! এরপর একটা রুই-কাতলা-ট্যাংরা-তেলাপিয়া উঠলেই সোনায় সোহাগা। ষোলোকলা পূর্ণ হয়। গোটা বাজারটাকে ট্রেনে এনে তোলা যায়। সত্যি, একটা বিদেশীর কাছে এ দৃশ্য! কী লজ্জা! কী লজ্জা! ভাগ্যিস, এটা ঘোর গ্রীষ্মকাল নয়। যাত্রীরা তো একে অপরের গায়ে ডলাই-মলাই করতে করতে চলেছে। তাতে যদি ঘেমো হতো তো কথাই নেই। কিন্তু সবাই নির্বিকার! মৈথেলি হাঁ করে দ্যাখে, কী অদ্ভুত এ্যাড্যাপটেশন! কী টলারেন্স! সরকার করছেটা কী! এই কি ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম? বসে বসেই অস্থির হয়ে উঠছে ও। দাঁড়িয়ে থাকলে তো হয়তো মেরে-মুরেই দিতো।

কিন্তু মৈথেলি’র মায়ের কোন হেলদোল নেই। মা একটু চুপচাপ। মেয়ে সবটা খুলে না বললেও নানা চিন্তা হয়তো করছে। মা তার ছোট্ট গণ্ডির বাইরে ভাবতে জানে না। রাজনীতি, অর্থনীতি, বেকারী, গণহত্যা, দুর্নীতি, জঙ্গি… কিছুই না। আজকে বোধহয় নিজের মা’কে নিয়ে খুব ভাবছে। মা একটু বেশি ভাবে। সত্যিটা বুঝতে পারে না। আরে, তুমি তো ডাক্তার নও। ভেবে-চিন্তে তো কোন স্টেপ নিতে পারবে না। ভাববে, ডাক্তার আর বড়মামা। তাছাড়া তোমার মা-এর বয়স হয়েছে। চলে যাবার বয়স থেকে বেশি। মেনে নাও। বড়মামীরও তো বয়স হয়েছে। সে বেচারি কি পারে এ্যাতো নার্সিং করতে!

শিয়ালদায় নামতে দেখলো, সেখানেও গিজ গিজ করছে হকার। গোটা প্লাটফর্ম-টা জুড়ে ওদের রাজত্ব। হাজার পসরা সাজিয়ে বসে আছে। সেই যে, ‘আমার এ ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম-রাবণ আছে…’। মানুষ এমন করে ডাকছে যেন ওদের থেকে জিনিস-পত্র কিনতেই মানুষ বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। ওদিকে স্টেশনে জন-সমুদ্র ঢুকছে-বেরুচ্ছে। মৈথেলিকে এসব পোয়াতে হয় না। ও যায় সেক্টর ফাইভ-এ। সেটা তো ঝাঁ চকচকে করপোরেট পাড়া। ওর অফিস তো কথাই নেই। সরকারি লেভেলের আচ্ছা-আচ্ছা উচ্চপদস্থ কর্মচারীও ওই অফিসে কোন কাজে ঢুকতে দু’বার ভাববে।

কিন্তু রবিঠাকুর বলেছেন, ‘আজি সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে।’ তার মানে, যাত্রীদের সাথে রং-মেলান্তি করতে করতে, গা ঘষতে ঘষতে অগত্যা মা-কে নিয়ে বেরলো স্টেশন থেকে। সামনেই এবার বাস। সেটা ততটা জ্বালালো না। স্টপেজে নেমে সেই কুখ্যাত রাস্তা। এখানে-ওখানে ছড়ানো শালপাতা, পলিথিন, মাছের আঁশ, ফলের আর তরকারির খোসা-ভুতি গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেসব ডিঙিয়ে-পেরিয়ে যেতে হবে। ফলে সালোয়ারটা খানিক তুলে নিয়ে ঘিনঘিন করা গা সামলাতে সামলাতে নিজেকে ‘কন্ট্রোল কন্ট্রোল’ বলতে বলতে যখন পৌঁছল বড়মামার বাড়িতে, তখন বিকেল পাঁচটা। সস্তায় জার্নি-র তিন অবস্থা। বড়মামা, ভাই, পঞ্চুমামারা সব গেছে নার্সিং হোম-এ। এখন সেখানে যাবার কোন মানেই হয় না। নার্সিংহোমটা কাছাকাছি নয়। তাছাড়া চেনাও নয়। থাক, এখানেই ডিটেল জেনে নেওয়া যাবে’খন। মা বলল,
- তুই কিন্তু এখনই চলে যাস না, মিতু। একটু বসে যা।
- কেন গো?
- মামারা ফিরুক আগে। অন্তত জেনে যা, দিদুন কেমন আছে।

সেটা তেমন জরুরি নয়। তবুও মনে মনে ভেবে নেয় মৈথেলি – কত আর রাত হবে! সাতটা, বা আটটা। বসাটা ভদ্রতা। টা নয়তো বাবাও জানতে চাইবে তার শাশুড়ির খবর। তাই মা’কে বলল – সে তো বটেই। এ্যাতোদূর এলাম কেন?

ল্যাপটপটা তাড়াহুড়োয় আনেনি সাথে। আনলে বসে কিছু কাজ এ্যাডভান্স করে নেওয়া যেতো। ঘুম তো হলনা। শরীরটা বেশ ঝুঁকে আসছে। ক্লান্ত লাগছে। মোটে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়েছে রাতে। এতে কি হয়! তাই বড়মামীকে বলে নিজেই চা বানালো, সকলকে দিলো, আর ফ্লাস্কে রেখে নিজে নিলো। যদি ম্যাজমেজে ভাবটা যায়। সোফায় বসে দেখলো, তলাকার তাকে একটা লেডিস ম্যাগাজিন রয়েছে। সেটা উল্টে-পাল্টে দেখে ঝিমুনি ভাবটা কাটাতে চাইলো মৈথেলি।

এখান থেকে বেরোতে সেই বেজে গেল সাড়ে সাতটা। ভাই বলল – চল দি’ভাই, তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
- না না, তুই বাড়িতে থাক। বড়মামী তো দিদুনকে দ্যাখে। তুই একটু তোর মা’কে দ্যাখ। মা কিন্তু ভেঙ্গে পরবে। আমি বেরিয়ে যাবো ঠিক। আমি তো একাই চলি রে, বাবা।

বেরিয়ে পড়ে শেষে মৈথেলি। কিন্তু রাস্তায় এসে দ্যাখে, একি! গোটা রাস্তা শুনশান। কোন হকার-ফকার কোথাও নেই। সব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এ্যাতো সকাল সকাল সব গেলো কোথায়! ওদের বিক্রী-বাটা কি মিতে গেলো! এটা কি সম্ভব! তাহলে কি হল্লাগাড়ি আসবে বলে কোন খবর আসতে সব কেটে পড়েছে? ওদের সাথে তো পুলিশের একটা আঁতাত থাকে। আগে থাকতে এসব খবর এসে যায়। ওরাই ভক্ষক, আবার ওরাই তো রক্ষক এদের। সর্বনাশ! এ তো কেউ কোথাও নেই! একটা দমকা হাওয়া যেমন রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজের টুকরোগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, তেমন করে এদেরকে কোথায় নির্বাসন দিয়ে এসেছে! এর আগেও তো এখানে এসেছে ও। রাত অন্তত সাড়ে ন’টা অবধি তো রাস্তাটায় লোকারণ্য থাকে। অবাঞ্ছিত স্পর্শ বাঁচাতে হেলে, গা বেঁকিয়ে-চুরিয়ে পার হ’তে হয়। তা নয়তো যেখানে সেখানে পা পড়ে যাবে, যার-তার গায়ে ধাক্কা লাগবে। কিন্তু এ তো ভালো জ্বালা হোল। এতো রাত দুটো’র রাস্তা! ঈশ্বর যেন ওর প্রার্থনা শুনে একটা পরিষ্কার রাস্তা ওকে উপহার দিয়েছেন। এবারে তো নো ঝুট, নো ঝামেলা। কিন্তু বেশ ভয় ভয় করছে তো! অচেনা অজানা জায়গা। তাই একবার মনে মনে ভাবল মৈথেলি, তাহলে ফিরে গিয়ে ভাইকে সাথে নিয়ে আসবে। ও যদি বাসে তুলে দিয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নারীত্বে লাগলো ওর। কেন? একজন পুরুষকে এভাবে অবলম্বন করতে হবে কেন? ভাই হলেও ও তো পুরুষ বৈ অন্য কিছু নয়। যদি দুম করে কোন অবাঞ্ছিত মন্তব্য করে বসে? থাক। কী আর হবে! একবার পেছনে তাকিয়ে ফেলে আসা রাস্তাটা দেখে নিয়ে একটু সাহসিনীর মতো পা দাবড়ে-দাবড়ে এগিয়ে চলল মৈথেলি। একটু এগিয়েই মনে হোল, কেউ বা কারা যেন ফলো করছে। একটু ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নিলো। হ্যাঁ, পেছনে আসছে দুটো লোক। চুপচাপ। সন্দেহজনক নয়, আবার সন্দেহজনক। একটু ভেবে মৈথেলি হাঁটা-টা একটু আস্তে করে দিলো। ওমা! লোকগুলোও তো ওদের গতি আস্তে করেছে! কী কেস? এবারে সাহসে ভর করে সোজা পেছন তাকায় মৈথেলি। মা বলে, ভয় পেলে নাকি এসব হয়। আসলে কেউ নেই, কিন্তু কেউ আছে বলে মনে হয়। কিন্তু কৈ? কেউ তো নেই! খেয়েছে! ভূত-টুত নাকি রে বাবা! বেমালুম উবে গেলো লোকদুটো! এখানে তো কোন গলি-ঘুজি নেই যে, ঢুকে পড়বে।

ভূত কখনও দ্যাখেনি মৈথেলি। কিন্তু এ দেশের মেয়ে ভূত মানে না, মানে, সে মেয়ে নয়। তাকে বলা হয় – এ মেয়ে তো মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়। ফের হাঁটতে গিয়ে গতিটা বেশ বাড়িয়ে নিলো মৈথেলি। হঠাৎই ও আবিষ্কার করলো যে, ওরা দু’জন নয়। এবারে চারজন জোরপায়ে ওকে ফলো করছে। মৈথেলি জানে, ওরা ওর থেকে কিছু নিতে পারবে না। ও সোনা-ফোনা পরে না। আর ব্যাগ-এ তেমন কিছু নেই। অনেকটাই মা’কে দিয়ে এসেছে বড়মামার হাতে দেবে বলে। অন্তত মা তো বড় বোন। তাই আর কোন চান্স না দিয়ে, সময় নষ্ট না করে এবারে দে ছুট। ওই তো বাস স্টপেজ। ওখানে তো লোকজন থাকবে নিশ্চয়ই। দেখলো, হ্যাঁ, আছে। একটা বাস’ও দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরই বাস। ধাঁ করে বাসে উঠে তবে নিশ্বাস নিলো মৈথেলি। যাক বাঁচা গেলো। মন বলল, না, তাহলে গোটাটা মনেরই ভুল। ওরা হয়তো নিরীহ মানুষ। বেকার ভয় পাচ্ছিলো।

শিয়ালদা স্টেশনে এসে দেখলো, আর একটা বিস্ময় ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। গোটা শিয়ালদা চত্বর-টা খাঁখাঁ। কোন হকার নেই। চাকরীর ফর্মওয়ালা থকে শুরু করে লেবুওলা পর্যন্ত। কেউ নেই। হোলটা কী! প্লাটফর্ম-এর বাইরে নেই, ভেতরে নেই। সিগারেট-বিড়ি তো আগেই উঠেছে। সাজানো-গোছানো একটাও দোকান, এমনকি হুইলারস-গুলো পর্যন্ত নেই। এই তো যাবার সময় দেখে গেলো। এর মধ্যে সব গেলো কোথায়! না হয় নতুন সরকার এসেছে। নানা ম্যাজিক করছে রোজ। করুক। কিন্তু এটা কী! দেশ কি পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত? কলকাতাকে তিলোত্তমা করতে সরকার হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কিন্তু এটা কি সম্ভব! এ্যাত দ্রুত! চারদিকে যদি এরকম নৈঃশব্দ থাকে, তবে তো মহা মুশকিল। না, প্যাসেঞ্জার আছে। তারা নানা ট্রেনে রোজকার মতো উঠছে-নামছে। সেখানে কোন গণ্ডগোল নেই। তবে আজকে ভিড় বেশ বে-এ-শ পাতলা। হঠাৎ মনে পড়লো, ওহো! আজ তো ঈদ ছিল। জেনারেল বা সরকারি ছুটিগুলো মৈথেলিরা ভোগ করতে পারে না বলে মনেও থাকে না, কবে কোন কমন হলিডে। ওদের তো তা নেই। প্লাটফর্ম খুঁজে দেখলো যে, ওর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শিডিউল টাইম জানে না ও। জানবার-ই বা কী দরকার! ছাড়বে তো বটে। এবারে তো নিশ্চিন্ত! কিন্তু ট্রেনের মধ্যেও এলো আতঙ্ক। একেই ভীষণরকম পাতলা প্যাসেঞ্জার, আর তার ওপর আজকে তো একটাও হকার-টকার নেই। নো লেবু লজেন্স, নো হরেকরকম পাঁজি-পুঁথি, নো বাদাম, নো সেদ্ধ ডিম। কী কেস রে বাবা! সব গেলো কোথায়? ও লেডিস্‌-এ ওঠেনি। লেডিস্‌ কামরা কোথায় পড়ে, জানেও না মৈথেলি। আজকে অত খোঁজাও যাবে না। গোটা চার নম্বর প্লাটফর্ম-টা ঘুমন্ত সাপের মতো একটু বেঁকে শুয়ে আছে। আরও আগে এগিয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার! বড্ড নির্জন, বড্ড একা একা। একটা নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করছিল ওকে। কবে যেন কে বলেছিল, ‘লেডিস্‌ কামরায় কোনোদিন ভুলেও উঠবি না। সব অসভ্য মহিলা উঠে বেজায় ঝামেলা করতে করতে যায়। মুখ খারাপ করে।’ তাছাড়া আজ যদি জেনারেল-এর এমন হাল হয়, তবে সেখানে তো একটাও মহিলা পাওয়া যাবে না। থাক, বাবা। দরকার নেই মহিলা সঙ্গ করার। পুরুষেরা অতটা অসভ্য হয়ে পারেনি এখনও।

কিন্তু ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন কামরায় সর্বসাকুল্যে গোটা দশেক যাত্রী। ট্রেন-টা ছাড়তে না ছাড়তে-ই গেটের মুখে দাঁড় করানো লোহার রড-টা দক্ষ হাতে ধরে কামরাটায় উঠে পড়লো চারটে লোক। মৈথেলির মনে হোল, এরাই যেন রাস্তার সেই চারটে লোক। ওকে ফলো করতে করতে ট্রেন অবধি এসে উঠেছে। ওই রাস্তায় আলো ছিল বটে। কিন্তু তা সেই কভার দেওয়া টিউব লাইট। তাতে পোকা আটকে পড়ে পড়ে আর মরে মরে তা তো অন্ধকার। অন্ধকারে তো লোক চারটের মুখ দেখতে ভালো দেখতে পায়নি মৈথেলি। এসব নিশ্চয়ই রাজনৈতিক গুণ্ডা নয়। রাজনীতি তো ও করে না। ওদের অফিসে তো কোন ইউনিয়ন-ফিউনিওন নেই। তাহলে শত্রুতাটা কী? ওকে ফলো কেন? ট্রেন ছাড়তেই লোকদুটো হঠাৎ তাদের মাজা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করলো। বেশ পরিষ্কার হওয়া গেল যে, ওরা ডাকাত। ঘড়ি, চেন, মানিব্যাগ, মোবাইল, আংটি, কেড়ে নিতে এসেছে। যেভাবে কলকাতায় হকার তুলে শহর-টাকে তিলোত্তমা বানানো চলছে, তাতে তো লোক এই ব্যবসা ধরবেই। আজকে এমনটাই প্রথম মনে হয় মৈথেলির। ও ভাবে, তা নয় তো ওদের স্ত্রী-সন্তান খাবে কী? যে কটা পুরুষ কামরাটায় বসেছিল, সব চুপচাপ। কোনো রা’টি নেই মুখে। মৈথেলির হাসি পেলো, এরা সব নাকি পুরুষমানুষ। বাড়িতে গিয়ে বউ-এর ওপরে পৌরুষ দেখায়। এখন দ্যাখো, যেন ভ্যাদা মাছ। ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। এর মধ্যে একটা লোক মৈথেলির কাছে এসে কোন কথা না বলে প্রায় বুকে হাত দেবার মতো করে হাত বাড়িয়ে ওর গলার চেন-টা ধরল।
- এটা খুলে দেবেন, না টেনে নেবো?
কাঁপতে কাঁপতে ও বলল – এটা… না… ইমিটেশন…। আমি… সোনা… পরি না।
- কেন সোনা পরিস না, শালী?
বলে এবারে ওর যত্নে ক্রীম মাখা, ফেসিয়াল করা তুলতুলে গালে পড়লো লোকটার হাতে মারা ‘ঠাস’ শব্দ করা একটা চড়।

ব্যস। চড় খেয়ে একটা ঝটকায় চোখ তাকিয়ে দেখলো মৈথেলি, সামনে ওর মামাতো ভাই দাঁড়িয়ে।
- দিভাই, তুই খুব ক্লান্ত, না? পত্রিকা-টা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলি। ঠাম্মা একটু বেটার রে। তুই এবারে বেরিয়ে যা। বাড়িতে তো পিসেমশাই আছেন। তোকে তো যেতেই হবে। আর রাত করিস না। সাড়ে সাত-টা বাজে। আমি তোর জন্যেই ছুটতে ছুটতে আসছি। আমি তো জানি, তুই খবরটা জেনেই যাবি। চল, তোকে এগিয়ে দিই।
- থাক। তোরা ক্লান্ত না? আমি পারবো। তোর দি’ভাই কি লবঙ্গ লতিকা নাকি?

ভাই-কে থামিয়ে দিয়ে এবারে মা-কে ডেকে মা’র হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে, নিজের চোখেমুখে জলের ঝাঁপটা মেরে বেরিয়ে পড়ে মৈথেলি। বেরবার সময় কাকে উদ্দেশ্য করে যেন প্রণামও করে নেয় একবার। রাস্তায় এসে দেখল, নাঃ, সব ঠিকই তো আছে। চারদিক আলো ঝলমল। লোহার রডে বাল্ব ঝুলিয়ে কত হকার নানা জিনিস বিক্রী করছে। জমজমাট গোটা রাস্তা। দুটো লোক বসে দারুণ দারুণ পারশে মাছ বেচছে। রূপোলি ঝকঝকে মরা মাছ। কিন্তু দেখতে জ্যান্ত জ্যান্ত। পারশে মাছগুলো যেন মৈথেলিকে ডেকে বলল, ‘এই মেয়েটা, ভেলভেলে’টা… ঝোল খাবি? তো মাছ নিয়ে যা।’ পারশে মাছ প্রিয় মৈথেলি’র। মনটাও দিব্যি ফুরফুরে লাগছে। তাই কোনো অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই আড়াই শো টাকা দরে কিনে নিলো হাফ কেজি। গোটা রাস্তা-টা যেন নাম-না-জানা উৎসবে মেতেছে। কত দোকান! কত হকার! এখানে কে কাকে ফলো করবে! কার বাবার সাধ্য! এ্যাতগুলো মানুষ আছে না! মেরে তক্তা খসিয়ে দেবে। মাছওয়ালাকে বলল, বড়ভাই, একটু ভালো করে প্যাক করে করবেন? আমি তো ট্রেনে অনেকটা যাবো। কেউ গালাগাল না করে।
- কোনো চিন্তা নেই, দি’ভাই। আজই কেটে সাইজ করে দারুণ করে দিচ্ছি। আপনি মনেও রাখতে পারবেন না, প্যাকেটে মাছ, না আপেল।
- আপনি আবার কাটবেন? আপনার তো অনেকটা সময় নষ্ট হবে, ভাই।
- আপনি দিদি, বোধহয় বাজার-টাজার যাননা, না? এটা আমাদের করতেই হবে। আমাদের কে শুনবে, বলুন?

মাছটা প্যাক করে নিয়ে হাঁটা দিলো মৈথেলি। গুনগুন করে গানও ধরল, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরেরও বাঁধনে…’ এবারে ছ-খানা হ্যান্ড-রুমাল কিনলো ফুট থেকে। বেশ ভালো। দোকানে কিনলে অনেক দাম নিত। স্টেশনে এসে স্টেশন-এ এসে দেখলো, নাঃ, কলকাতা আছে কলকাতাতেই। কোথাও কোনো চেঞ্জ নেই, কোনো নতুন আইন নেই, কোনো সর্বনাশ ঘটেনি কোথাও। ঠাণ্ডা মাথায় টিকেট-টা কাটল মৈথেলি। ভিড়ে ভিড়াক্কার শিয়ালদা স্টেশন। প্ল্যাটফর্ম চেঁচামেচি-তে পরিপূর্ণ। ‘চিৎকার চেঁচামেচি ব্যস্ততা… এই নিয়ে হোলো কলকাতা…’

ট্রেনে উঠে আরামে নিশ্চিন্তে চোখটা বুজে নিলো মৈথেলি। না, ঘুম আসছে না। বড় আরাম লাগছে। মন গাইছে, ‘বড় বিস্ময় লাগে…’ আজকে প্রথম রাস্তায় বেরিয়ে বড় আনন্দ লাগছে ওর। কোথাও কোনো বিপদ নেই, খেদ নেই, ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, ঘেন্না নেই, ছুৎমার্গ নেই। চারদিকে মানুষ আছে। অনেক অনেক মানুষ। তারাই তো ভরসা। তারাই তো পানের থেকে চুন খসলে ছুটে আসবে। এটাই তো আমাদের চেনা শহর। আমাদের তিলোত্তমা। মনে পড়ে, টেলিভিশন-এ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম রাদিচে বলছিলেন যে, কলকাতা নাকি বড় নিরাপদ শহর। এমনটা নাকি লন্ডন-এ সম্ভব নয়। কে জানে বাবা!

হঠাৎ কানে আসে, ‘ছোলে! এ সেদ্ধ ছোলে! মশলা ছোলে!’

চোখ তাকায় মৈথেলি। একটা বাচ্চা ছেলে রাত ন’টায় একটা ঝুড়িতে লাল কাপড় দিয়ে আবৃত ক’রে সেদ্ধ ছোলা বেচছে। কাপড়ের ওপর সাজিয়ে রেখেছে অর্ধেক করে কাটা পাতিলেবু। এই মশলা ছোলা ছোটবেলা খেতো মৈথেইলি। আজ দেখে নোলা-টা সপ সপ করে উথলো। বড় হয়ে অবধি এসব তো খাওয়াই হয় না।
- আমাকে চার টাকার দেতো, বাবা। ফাইন করে দিবি কিন্তু। লেবু দিবি না।

এ্যাতো রাতে কোনো দিদিমনি ছোলা কিনবে – এমনটা ছেলেটার অভিজ্ঞতায় নেই। তাই খুব মন দিয়ে ঝালনুন-টুন দিয়ে লোভনীয় মিক্সচার বানালো। একটু মুখে দিয়ে মৈথেলি বলল, দারুণ বানিয়েছিস। তোর নাম কী রে?
- মন্টু।
- কোথায় থাকিস তুই?
- আগরপারায়। রেলবস্তিতে।
- শোন, এরপর থেকে লেবুগুলো না, কেটে কেটে রাখবি না। বিষ হয়ে যাবে। বুঝলি?

ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় দিতেই ওকে টাকা দেয় টেকনোপলিসের এক্সিকিউটিভ মিস মিত্র। আর এই প্রথম ওরকম একটা নোংরা ছেলের চিবুক নিজের পাঁচ আঙ্গুলের মাথা দিয়ে ছুঁয়ে নিজের ঠোঁটে ছোঁয়াতে গিয়েও ছোঁয়াল না মৈথেলি। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সবাই দেখছে।