অনিরুদ্ধ সেন

 

“আমি কি আপনার কোনো সাহায্যে আসতে পারি, ম্যাডাম?”

প্রবল হাওয়া ঠেলে অতি কষ্টে ক্যাফেটারিয়ার দিকে এগোবার চেষ্টা করছি, এমন সময় পেছন থেকে ভেসে এলো সেই অতি পরিচিত স্বরে এই ডাক। চমকে ঘুরে তাকালাম। সন্দেহ নেই – সে! উত্তেজনায়, শিহরণে আমার রোমকূপ খাড়া হয়ে উঠলো – যেমন তখনও হতো।
ও কিন্তু আমায় মোটেও চিনতে পারেনি। যাক, তাতে আমি আঘাত পাইনি। শেষ দেখা হবার পর আমরা দুজনেই অনেক বদলে গেছি, বিশেষতঃ আমি। তাছাড়া কোনো পুরুষের পক্ষে একটি মেয়েকে স্রেফ তার চলার পথের একটি মাইলফলক হিসেবে দেখা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে সে যদি ওর মত পুরুষ হয়।
কিন্তু যখন একই মাইলফলক আবার ফিরে আসে? তখন বুঝতে হবে, বাছা, এবার তোমার ঘরে ফেরার পালা! আগে যখন আমাদের দেখা হয়েছিলো, আমি অনভিজ্ঞ ছিলাম। তাই আমার দ্বিধাগ্রস্ত বাহুবন্ধন এড়িয়ে তুমি পিছলে বেরিয়ে গেছো। সে ভুল আমার আর হবে না। এই হঠাৎ দেখা আমার বুকের এক গভীর ক্ষতকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। বুঝতে পারছি, জীবনে কি মরণে ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না!

সুতরাং হাজার ভোল্টের এক হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে আমি উত্তর দিলাম, “ধন্যবাদ, তার দরকার হবে না। তবে কী, এই গা ছমছম হিল রিসর্টে এতক্ষণে একটা জীবন্ত প্রাণী চোখে পড়লো। এই হতচ্ছাড়া আবহাওয়াতে যদি আর কেউ জিন্দা থেকে থাকে তবে তারা ঘরে রুম হিটার চালিয়ে কম্বলের তলায় আরামসে ঘুম মারছে। কাজেই আপনি যদি ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমাকে একটু সঙ্গ দেন –”
“সানন্দে!” বলে সে নিবিড় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টি – যার সামনে পড়ে আমার ভেতরটা আগুনের সামনে এক তাল মোমের মতো গলতে শুরু করলো। যেমন তখনও গলতো।

“মহিলারা অচেনা পুরুষদের সম্বন্ধে সাবধান থাকবেন – এক সিরিয়াল কিলার আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে,” স্থানীয় নিউজ চ্যানেল বারবার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। আমারও কি সাবধান হওয়া উচিত নয়? না না, ও তো আর আমার অচেনা নয়। বরং কখনো কখনো মনে হয়, ওর সাথে আমার কত সহস্রাব্দের পরিচয়।
ও এক নিঃশ্বাসে কত কথা বলে চলেছে, বোধহয় আমাকে পটানোর জন্য। বেকার পরিশ্রম – আমি তো ওর রসে মজেই আছি! মুগ্ধ হয়ে আমি একতরফা শুধু শুনে যাচ্ছি। অবশ্য কী-ই বা আমার বলার আছে? আমার যে অতীত ছাড়া কিছু নেই – সেসব প্যানপ্যানানি কি আর ওর মনে দাগ কাটবে!

ব্রেকফাস্টের পর ও দিলদার হয়ে আমাকে ওর হোটেল রুমের উষ্ণতায় বসে আড্ডা মারার জন্যে আমন্ত্রণ জানালো। বাইরের আবহাওয়া যদিও জঘন্য, তবু সেই আমন্ত্রণ বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করে আমি বাগানে হাঁটার প্রস্তাব দিলাম। ততক্ষণে আমি ওর জন্য মরে যাচ্ছি, কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম। নিজেকে হুঁশিয়ারি দিলাম – খুব তাড়াতাড়ি বেশি এগিয়ে সব মাটি ক’রো না। ধৈর্য ধরো, ও তোমারই হবে!
বাগানটি অতীব সুন্দর। ঝাঁক ঝাঁক দৃষ্টিনন্দন ফুল প্রতিকূল আবহাওয়ার দাপটে অস্তিত্বরক্ষার চেষ্টায় কুঁকড়ে রয়েছে। একটি অর্কিড পড়ে আছে দেখতে পেয়ে আমি তা তুলে নিয়ে ওর হাতে দিলাম।
“জানলেন কী করে যে আমি অর্কিড ভালোবাসি?” ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“এই, কেমন যেন মনে হলো।” আমি লজ্জায় লাল হয়ে বলি।
আমার মুখের দিকে অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ও বললো, “আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। আগে কি কোথাও দেখেছি?”
“হয়তো কখনো কোনো ভিড়ের মধ্যে হবে।” অতি কষ্টে চোখের জল সম্বরণ করতে করতে বলি।

“যদি গুস্তাখি মাফ করেন তো বলি –” ও ইতস্তত করছে।
“করলাম, বলুন”, আমি হেসে ফেলি।
“আপনি কি কখনো ভালোবেসেছেন?”
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে আমি অতি কষ্টে উত্তর দিই, “আমার ভালোবাসা? সে আমায় ভুলে গেছে।”

“আহাম্মক!”
“কী বললেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
“বলছি, এমন ফুলের মত সুন্দর একটি মেয়েকে যে ভুলে যেতে পারে, সে আহাম্মক ছাড়া আর কী?” ও জেদি গলায় বলে।
আমি উত্তর দিই না। কিছুক্ষণ পর ও আবার বলে, “ঔদ্ধত্যের জন্য আবার মাফ চাইছি – আমি কি জানতে পারি কী ধরণের প্রেমিক আপনি পছন্দ করেন?”
“কেন, বাচ্চা মেয়েটির হাতে তার পছন্দসই ললিপপটি তুলে দেবেন বলে?” আমি খিলখিলিয়ে হাসি।
“চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী!” ও হেসে উত্তর দেয়।
কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় তলিয়ে যাবার পর আমি আবিষ্ট স্বরে বলি, “আমি সেই প্রেমিকের স্বপ্ন দেখি, যে তার ভালোবাসার প্লাবনে আমার শ্বাসরোধ করে দেবে, আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, আমাকে – আমাকে শেষ করে ফেলবে!”
এক মুহূর্তের জন্য আমি ওর চোখে দেখতে পেলাম আগুনের ফুলকি। পরক্ষণেই আবার চট করে আত্মসম্বরণ করে ও আমার দিকে শুধু হাত বাড়িয়ে দিলো।
কী কপাল – সেটুকুও আমি গ্রহণ করতে পারলাম না! “না, এখনও সময় হয়নি।” ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গীতে বললাম।
“কিন্তু সময় যে ফুরিয়ে আসছে। কাল আমি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাবো।” ও মিনতি করে।
“বিশ্বাস করুন, তার আগেই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে,” আমি কথা দিলাম।

নিঃশব্দে দু’জনে পথ চলছি। এক সময় পথ ফুরিয়ে গেলো, সামনে এক অতল খাদ। অনেক নীচে পাতায়, ফুলে ঝলমল প্রকৃতির শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য। কিনারায় এসে খাদের কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। দমকা হাওয়ায় উড়তে লাগলো আমার কাপড়ের খুঁট আর চুল।

“হাতব্যাগ সামলে, ম্যাডাম – হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে।” ও পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললো।
ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে বললাম, “তা আর বলতে – আমার সর্বস্ব তো এটারই মধ্যে।” তারপর একটু হেসে বললাম, “আমি যদি এখানে একটু দাঁড়াই, আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না?”
“না, না, আমি অপেক্ষা করছি,” বলে ও এক পাশে সরে দাঁড়ায়।

আবহাওয়া জঘন্য থেকে জঘন্যতর হচ্ছে। ঘন কুয়াশায় ধীরে ধীরে চারদিক ঢেকে যাচ্ছে, কয়েক হাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। হিমেল হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তবু আমি স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে। চারপাশ নিথর, নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছে, সময় ছুটি নিয়েছে।
তারপর এক সময় আমি পেছন ফিরে দেখি, ও পাশে নেই। কয়েকটি আশঙ্কাজনক মুহূর্ত, তারপর হঠাৎ আমার হাতের ব্যাগে এক হ্যাঁচকা টান আর আমার ঘাড়ের পাশে এক উত্তপ্ত নিঃশ্বাস। একটি সবল পুরুষালি বাহু পেছন থেকে আমায় প্রবল ধাক্কা দেবার জন্য উদ্যত। খাদের কয়েক ইঞ্চি দূরে আমি স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে। চূড়ান্ত মুহূর্তটি কি তবে এসে গেলো?

“হল্ট!” হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে ওঠে আর সাথে সাথে বেজে ওঠে এক তীক্ষ্ণ পুলিশি হুইসল। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। একটি শরীর খাদের কিনারা থেকে সামনের অনন্ত শূন্যে ছিটকে পড়ে, কোনো হতভাগ্যের করুণ মৃত্যুকাতর আর্তনাদে দিগন্ত কেঁপে ওঠে, তারপর আবার সব নিস্তব্ধ।

“ইস, ব্যাটা সিরিয়াল কিলার শেষ অবধি আমাদের হাত এড়াতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলো!” সাব-ইনস্পেক্টর দুঃখ করে বললেন।
“তুমি কি নিশ্চিত যে লোকটা একাই গেছে?” ইনস্পেক্টারের তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, “আমার যেন মনে হলো ও কাকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিচ্ছে?”
“স্যার, আমার ইনফ্রা-রেড চশমা দিয়ে আমি সব স্পষ্ট দেখেছি – লোকটা ছাড়া এখানে আর একটা কুত্তাও ছিলো না। তবে ওর মাথাটা বোধহয় একেবারে গিয়েছিলো – নিজের সাথেই কথা বলছিলো আর যেন ছায়ার সাথে যুদ্ধ করছিলো। সেভাবেই খাদের কিনারায় কাল্পনিক কাউকে ধাক্কা দেবার ভঙ্গী করতে করতে হঠাৎ নীচে লাফিয়ে পড়লো।”
“উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে!” ইনস্পেক্টর বলেন, “তুমি বোধহয় জানো না ওর প্রথম শিকার যে মেয়েটি, তাকে ও প্রেমের ফাঁদে ফেলে ঠিক এই জায়গাটাতে টেনে এনে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। অমন ফুলের মত সুন্দর একটি মেয়ে – কতটা পশু হলে একজন মানুষ স্রেফ অর্থের লোভে তার জীবনদীপ নিভিয়ে দিতে পারে!”
“চলুন স্যার, যাওয়া যাক।” সাব-ইনস্পেক্টর এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাট চুকোবার উদ্যোগ করেন।

আর আমি আমার অর্কিড হাতে নিয়ে অপেক্ষা করে থাকি। পৃথিবীর গভীর জঠর থেকে অবিরাম উঠে আসা কুয়াশার বাষ্প পাহাড় ঢেকে ফেলছে। তার পাখায় চড়ে এবার ও উঠে আসবে শুদ্ধ জ্যোতি হয়ে, পাশে এসে বসে আমার হাত ধরবে। আমার হৃদয় আবার নেচে উঠবে উচ্ছ্বাসের জোয়ারে। ও আমার, চিরদিনের জন্যই আমার হবে। মানুষ নশ্বর, প্রেমের মৃত্যু নেই।