রামপ্রসাদ কর


এক আকাশ অন্ধকার মাথায়
নিয়ে বসে আছে একটা কালো বিড়াল
চারিদিকে গা ছমছমে নীরবতা
আর হাড় হিম করা অন্ধকার।
সেই কবে থেকে বসে আছে
বিড়ালটা, সমস্ত আলো নিভে
কেমন করে কালো কার্বনের
মতো অন্ধকার নামল
অফিস পাড়ায় – সব দেখছে সে।
বাতাসে ভারী পর্দা দুলে ওঠে
সিঁড়িতে কাদের আনাগোনা!
কাঁটা-চামচ আর কাপ-প্লেটের
ঝনঝন শব্দ,
করিডোরে পাতাবাহার গাছেরা
লজ্জায় শুকিয়ে কাঠ,
– কোনো উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের
পদস্খলন হল বুঝি।
দমকা হাওয়ায় ঘরের আলো
এক এক করে নিভছে,
খোলা ফাইলের পাতাগুলো
সামনে-পিছনে, ডাইনে-বাঁয়ে
উড়ছে, কে যেন
‘সৎভাবনা’ ‘স্বচ্ছতা’ ইত্যাদি শব্দ
লেখা কাগজগুলো বাস্কেটে
ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।
একেবারে কোণের ঘরের
দেওয়ালের ঈশাণ কোণে খালি গায়ে,
খালি পায়ে, হাতে লাঠি, গোল চশমা পরা
এক বৃদ্ধকে নড়েচড়ে
উঠতে দেখে বিড়ালটা
ভাবল এবার বোধহয়
তার চলে যাওয়ার
সময় এসেছে।

ময়ূরী ভট্টাচার্য্য


অপারমিতা
চিলেকোঠার চড়াইটা তার সপসপে ভিজে ডানাতেও উষ্ণতা খোঁজে
যদিবা অন্ধকার ঘরে ঘুলঘুলির আলোতেই ভোর হয়
অপারমিতারা দূরে টুপটুপ জোনাকির সবুজ আলো হয়ে জ্বলে
জোনাকিদের ভালোবেসে পাগল সাঁতারু
হেমন্তের শীতভাঙা নদীতে ডুব দেয়
হয়ত, রাত থাকতে থাকতেই কারো মনে
কোথাও প্রেরণা জ্বলে উঠবে।

এক চিলতে
এতটুকুও ফাঁক রাখিনি
মধুকোড়ের তো পাত্র আছে
নিঃস্বের দুটো হাতই শুধু সম্বল
তোমার সামনে যদি উজাড় করি
আমায় করুণা কোরো না
রাশি রাশি চাই নি তো
যদি পারো দু-এক পশলা হেলায় দিও ফেলে
সুবর্ণরেখার জল ছেঁকে ছেঁকে স্বর্ণকণা জমায় যারা
তার চেয়েও যত্নে রাখতে পারি
তোমার মুখের এক কণা হাসি।

বিমুখ
তোমার অহেতুক নিষেধ আমি মানছি না শঙ্করপ্রসাদ
প্রচণ্ড খরার দিনেও আমি নদী সাঁতরেছি
তোমার নিষ্ঠুর অবহেলা আমায় ব্যথা দেয় না–
যত বেশি এড়িয়ে চল তুমি
জানি, নিজের অজান্তেই তত গ্রহণ কর আমায়।
নির্বাক সাক্ষাতেও ছুটি নেই তোমার;
তুমি জানো না, কে যেন অনর্গল
কথা বলেই চলে, নিভৃতে – তোমার সাথে।
সে তুমি যতই বিমুখ থাকো না কেন!

মায়া
তোমাকে কখনই কোমল মনে হয় নি।
বারবার খুঁজেছি – ধরা দাও নি।
আমার বিনিদ্র রাতে ছায়া হয়ে আসো নি কখনও।
আমার তপ্ত কপালে কখনও ক্ষমার হাত রাখো নি।
কিন্তু কী অদ্ভুত দেখো আজ অনেক দূর থেকে তোমাকে অন্যরূপে দেখছি।
তোমার কোমল গন্ধের শরীর মায়ার আঁচলে ঢেকে দিচ্ছে সব কিছু।
আমি হারিয়ে যাচ্ছি।

কৃষ্ণকুমার গুপ্ত


আমাদের আয়ু খুব সীমিত
পরিমিত সময়ের শেষ প্রান্তে উপস্থিত
আমরা দু’জন,
এখন শেষ হয়ে যাবে ফুলের ঘ্রাণ,
কচুপাতার চরম সবুজতায় উপস্থিত
এক ফোঁটা টলটলে অশ্রু।
সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে আজ
ভীষণ মলিন আগামীকাল
আর দেখা হবে না কখনো,
আগামী কখনো আজকালকার মতো
জড়িয়ে থাকবে না হৃদয় জুড়ে,
সেখানে হয়ত অন্য নারী
অন্য স্বপ্ন, অন্য সকাল দুপুর।
সময় রঙ মাখে গায়ে
প্রতিনিয়ত চক্রাকার এই আবর্তনে
আমরা বারবার আসি
হাসি কান্নায় বেঁচে থাকি আর
অনায়াসে বলে দেই, বিদায়।

জ্যোতিষ্ক দত্ত


লেখার ইচ্ছে কেন হয়, সে নিয়ে আর ভাবিনা আজকাল, ভয় করে ওরা জেনে যাবে, তাও লিখি – লেখা শুরু করার আগে, মাঝে মাঝে নিজেকে বড়ো নগ্ন মনে হয় আমার সমস্ত ভ্রূণ কবিতার কাছে, এক একদিন তাদের ভয়ে আমি আলোর বৃত্তের দিকে পালিয়ে যাই, আর এক একদিন আমাকে লাত্থি মেরে পাঠানো হয় আমার মৃতবৎসা শব্দের কাছে…

এক একদিন বাইরের আলোটা ওরা নেভায় না,
শব্দ গুলোও খুব আঠালো লাগে, জানলার কাঁচে কয়েকটা দাগের মতন
ক্লান্তি লেগে থাকে বিছানার ভাঁজে…
আমি উঠে বসি, নিজেকে কুড়িয়ে নিতে বেরিয়ে আসি
ডালপালা সামনে যা পাই জড়িয়ে,
আর আমার সাথে ঠিক তখনই দেখা হয়ে যায় একটা আশ্চর্য লাইনের
তাকে কুশল জিজ্ঞেস করি,
একটা চেয়ার টেনে দিই… এক গ্লাস জল, হাতপাখা,
আজকের পত্রিকাটা আড়চোখে খুঁজতে খুঁজতে বলি,
‘উনি তো বাড়ি নেই, এই এক্ষুনি বেরোলেন…
একটু বসুন’…
একটা খুব চেনা স্বর তখন আমায় খোঁজে ভেতর ঘর থেকে,
আমাকে বকে,
নাম ঠিকানা জানতে চায় ওদের,
আমি জিজ্ঞেস করবো ভাবি – সাহস করে একপা এগিয়ে দেখি,
সামনে সেই নরম বিছানা…
আর তার ভাঁজ ভাঁজ থেকে জোর করে মুছে দেওয়া আমার ক্লান্তি আর
কয়েকটা অন্ধকার…

দীপা পান

 

প্রস্তুতিঃ
আমি গর্ভিণী মেঘেদের দিকে চেয়ে চেয়ে
ক্লান্ত কামনায়।
বহু দূরের প্রিয় কোনো জায়গা থেকে ধীরপায়ে
ফিরে আসার পর ঘামের রেণুর মত ম্রিয়মাণ
গোপন গ্রন্থির দ্বারে…

আজকে আমার চোখ টেনেছে শুকনো একটা নদী
কার ক’ ছটাক রোদ পড়েছে ভাগে
কার ক’ মুঠো বালির মত শোক –
হিসেব কষে না-জন্মানো টান
আর আমি ওই নদীর সাথে মিশে
স্রোতের জন্য খুঁজতে থাকি আলো
বৃষ্টিভারে শরীর ভাঙার স্বপ্নে লিখতে থাকি
বিষাদমোচন সংলাপ…

এবং তারপরঃ
তারপর ডুব দিয়ে জেনেছি জল কতটা গভীর
কিংবা ঢেউয়ের বিস্তার কতদূর
আবার সাঁতরে ফিরে এসেছি ঘাটে
প্লবতা চর্চার উৎসাহে।
প্ল্যাঙ্কটনের উদ্দীপনার অবশেষরূপে
তুমি…
আসলে ফেরিঘাট;

জলের গভীরতা মেপে সংরক্ষণ করেছি তথ্য
অসংখ্য রাত ফুরিয়ে গিয়েছে শুধু,
অন্বেষণর উত্তাপ আল্পনা এঁকে দিচ্ছে
মাছের ঠোঁটের বুদ্‌বুদ্‌।

উৎসবঃ
আর যখন গিরিখাতের ঠিকানা পেলাম
জলের শব্দের উপমা মাখে নি
পোষাক খোলার গুঞ্জন,
ক্লান্ত রঙ্গন তখন বেশ চনমনে
একটু একটু মনে পড়ছে গতজন্মের রঙ,
ব্রাশ ও বালতির ঠিকানা

তারপর ক্লান্তিতে হাতপাখা—
খসে যায়
কোথায় তলিয়ে যায়
জানিনা!
সেখানে
জলের মধ্যে জলের সেতু সুঠাম – উচ্চকিত পেশী
সেখানে
আকাশের প্রতিবিম্ব উদ্‌যাপন করে ডুবসাঁতার…

বন্দনা মিত্র

 

মা, সেই যে মেয়েটি পাখি হতে পারত, তার গল্প বল না।
– শোন তবে, এক যে ছিল মেয়ে, তার ছিল দুই ডানা।
কখন কিভাবে যেন পাখি হওয়ার বর পেয়েছিল সে,
যখন খুশি উড়তে পারত না দেখা ডানায় ভর করে
কেউ জানতে পারত না।

ডানাদুটো কেউ দেখতে পেত না বুঝি? লুকোনো থাকত?
– তাছাড়া কি ? সেটাই তো বর পাওয়ার মজা।
ভোর বেলা যখন ময়ূরকন্ঠী রঙের আকাশে লাল সুতোর আঁকিবুঁকি
সে ঘুম থেকে উঠে দাঁড়াত ছাদের আলসে ধরে
উড়ান দিত সবার অলক্ষ্যে
উড়ত যতক্ষণ না কেউ ডাক দেয়
- হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়, কাজকর্ম নেই?
পাখি নেমে আসত ভুঁয়ে।
সারাদিন রান্নাঘরে ধোঁয়ার আলপনায় ঘামতে ঘামতে
অফিসের ছোট্ট ঘরের দমবন্ধ দেওয়ালে
ভাঙা চুনবালির কারুকাজ দেখতে দেখতে
ভীড় বাসের অসহ্য গরমে এক অচেনা চেনা মুখ খুঁজতে খুঁজতে
সে অদৃশ্য ডানা মেলে ঘুরে বেড়াত।

তার খুব দুঃখ ছিল বুঝি মা?
– দুঃখ কোথায় – তার তো ভীষণ সুখ।
আকাশে উড়লে মানুষ ছোট্ট পুতুলের মত লাগে।
নীচের কর্কশ চিৎকার ফিসফিস কানাকানি
কিচ্ছু শুনতে পাওয়া যায় না।
পাখির মনেই পড়ে না মাটিতে তার বাসার কথা।

তারপর কি হল মা?
– তারপর… তারপর একদিন সবাই মিলে তাকে খুব বকলো
কেন সে থেকে থেকেই খাঁচার দরজা খুলে আকাশে উড়ে যায়?
এটাতো নিয়ম নয়।
একটা বিরাট কাঁচি নিয়ে তার ডানাদুটো কেটে দিল ওরা।
সে মেয়ে আর পাখি হতে পারত না।

তারপর – মা তারপর?
– ডানাদুটো তুলে খুব যত্ন করে রেখে দিল সে।
মাঝে মাঝে রোদে দিত, যাতে মরচে না ধরে।
তারপর তার ছোট্ট মেয়ে একদিন যখন তার আঁচল ধরে বসলো গল্প শুনতে,
আস্তে আস্তে ডানাদুটো বার করে তার পিঠে জুড়ে দিল।

মেয়েটাও কি পাখি হয়ে গেল মা?
– সে কথা তো তুমি বলবে মা!

অর্ণব চক্রবর্তী

 

সূর্য এখন খর –
ক্ষয়া ছায়া পায়ের নীচে
বাতাসে পচা লাশের গন্ধ
দুপায়ে মাড়িয়ে যাওয়া
দিনে বহুবার আত্মকে।

রুক্ষতার স্তবে চরাচর মগ্ন
হঠাৎ এফ এমে ভাসা রবীন্দ্রনাথ…
শুদ্ধতার ভৈরবী ছুঁয়ে যাক
পোড়া সব হৃদয়কে।

About this blog

hit counter

Sample text

ফেসবুকে আমাকে ফলো করুন

ভিজিটর কাউন্ট

Resources

মোট পোস্ট হল

জনপ্রিয় পোস্ট গুলি

আজকের তারিখ হচ্ছে

Powered by Blogger.

Ads 468x60px

Social Icons

সমস্ত পোস্ট গুলি এখানে

Featured Posts