"চাইনা মেয়ে তুমি অন্য কারো হও...” রেডিও তে গান টা শুনতে ভালই লাগছে।

আজ জুন মাসের 4 তারিখ, বাংলা মাস হিসাবে জ্যৈষ্ঠ চলছে। বৃষ্টি বাদলা হচ্ছে মাঝে মাঝে, কিন্তু গরমটাও প্রচণ্ড। আজকে আবহাওয়াটা অবশ্য ভাল, আকাশটা বেশ মেঘলা মেঘলা সকাল থেকেই। একটু পর পরই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। আমি একটা চায়ের দোকানে বসে আছি। মামা লাল চা টা বেশ ভাল বানায়, সাথে টানছি বেনসন। চা খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কোথায় যেন লাল চায়ের সাথে প্রেমিকার অমৃত ঠোঁটের লালার তুলনা বিষয়ক একটা লেখা পড়েছি সেদিন। চা খাওয়ার সময় কথা টা মনে পড়লেই কেমন জানি গা গুলাতে থাকে, কোন মানে হয়?

রাস্তায় মানুষজন ব্যস্ত ভাবে চলাফেরা করছে, প্রচুর রিকশা আর প্রাইভেট গাড়ি। আমার দিকে সব মেয়েদের উৎসুক দৃষ্টি ভালই খেয়াল করছি। মনে মনে হাসি আমি, আর ভাবি যে ওদের তো কোন দোষ নেই, খোদা আমাকে বানিয়েছেনই এমন। কি আর করা! চা শেষ করে দাম মিটিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করি, বাসায় যাওয়ার আগে আমার কি জানি নেয়ার কথা। হাঁটছি আর ভাবছি, হঠাৎ কানের কাছে কে যেন আচমকা একটা ফুঁ দিল, চমকে উঠলাম। প্রায় সাথে সাথেই বুঝতে পারি শিমুলের কাজ। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু কিছু বললাম না। শিমুল সব সময়ই কেমন অস্থির অস্থির, চোখ গুলি অনবরত নড়াচড়া করে। দেখলেই মনে হয় ঘোর অসুস্থ মানুষের দৃষ্টি। শিমুল চুপচাপ আমার সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটছে আর ইতিউতি তাকাচ্ছে। একটু পর শিমুল বলল,
-"কিরে অনেকদিন তো হয়ে গেল, আর মজা হবেনা?"
-"হবে, হবেনা কেন? তুই জানিস না এগুলোতে একটু সময় লাগে?"
-"হাহাহা, তা অবশ্য লাগে। ঠিক আছে দেখা যাক…”, শিমুল যেমন হঠাৎ আসে তেমনি হঠাৎ চলে যায়। আমি আবারো হাঁটতে থাকি। মনটা বিষিয়ে আছে শিমুলের কথা শুনে। আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় যে অনেকদিন ধরেই মনমতো মজাটা করতে পারছিনা! ইচ্ছেটা প্রচণ্ড ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে প্রায়ই, কিন্তু অনেক ঝামেলা, ঝুঁকিও বেশি আজকাল। মাথার ভেতরে সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, ঠিক এসময় আমি আটকে গেলাম।

আমি হাঁটছিলাম গলিটার বাম দিক দিয়ে। গলির দুই দিকেই আবাসিক দালানকোঠা আর ছোটছোট দোকানপাট। রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটা হুড তোলা রিকশা এসে থামল ঠিক আমার বামের লাল গেটটার সামনে, আরোহী একটা মেয়ে। নামল মেয়েটা, হাত বাড়িয়ে রিকশাওয়ালাকে টাকা দিল। ফর্সা হাতের কব্জিতে চিকন একটা সোনালী ব্রেসলেট। গেট দিয়ে ঢোকার মুখে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল, আমি সেই চোখেই আটকা পড়লাম। মেয়েটার চোখেও মনে হয় বিস্ময়ের ছায়া দেখতে পেলাম একটু, কিন্তু এক মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েটা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।

আমি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। ভিতরে সেই বহু পরিচিত অনুভূতিটা মোচড় দিয়ে উঠছে! কোন কিছুকে পাওয়ার অদম্য আকুলতা, তীব্র ইচ্ছাটা আমাকে অবশ করে দিচ্ছে। নিজেকে সামলানোর প্রবল চেষ্টা করি আমি, বাইরে দিয়ে স্বাভাবিক থাকতে হবে অন্তত যেভাবেই হোক। কিন্তু ওই চোখ দুটো তো সব উলটপালট করে দিচ্ছে! মনের অজান্তেই ঠিক করে ফেলি ঐ চোখদুটোকে আমার খুব কাছে থেকে দেখতে হবে, খুউব কাছে থেকে, এত কাছে থেকে যে আমার মুখে যাতে মেয়েটার নি:শ্বাসের ছোঁয়া পাই। চূড়ান্ত সময়টাতে ওর চোখের তারার দিকে তাকিয়ে কি দেখতে পাব ভাবতেই আমার সারা শরীর শিরশির করে উঠে! রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন রোমাঞ্চ খেলা করতে থাকে, নেশা নেশা ভাব হয়...

বাড়িটা চিনে রেখে আবার হাঁটতে শুরু করি। মনে মনে অনেক কিছু ভাবছি, এই সময় আবার শিমুলের যন্ত্রণা শুরু হল,
-"কিরে পেয়ে গিয়েছিস মনে হচ্ছে!"
-"হুমম... হয়তো"।
-"খিক খিক... মেয়েটাকে দেখে তোর তো অবস্থা কেরোসিন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুই ভিতরে ভিতরে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছিস! আহা! কবে করবি কাজটা?”
-"দ্যাখ ভ্যাদড় ভ্যাদড় ছাড়! এত বিরক্ত করিস ক্যান? তখন বললাম না এসবে একটু সময় লাগে... বাংলা বুঝিসনা নাকি?"
-"মেয়েটা কিন্তু একটা জিনিস রে!! লোল টানার মত আওয়াজ করে শিমুল, গলা উত্তেজনায় কেমন যেন ঘড়ঘড় করতে থাকে। “পারলে আমিই...”, আমার রক্তচক্ষু দেখে মিইয়ে যায় ও।
-"ঠিক আছে আমি চুপ করছি, কিন্তু ভাই খুব বেশি সময় নিস না। গরম গরম জিলাপির মজাই আলাদা!!”

হঠাৎ মনে পড়ল আম্মা মেঘলা দিন দেখে খিচুড়ি করবে বলছিল, তাই আমাকে মুদি দোকান থেকে মুগ মসুর ডাল নিতে বলেছে। সামনেই স্টোর, তাড়াতাড়ি পা চালাই আমি।



কার্জন হলের বাইরে গাড়ি পার্ক করে দাঁড়িয়ে আছি। সিগারেট টা শেষ করে হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ১টা বেজে ৩৮ মিনিট। রিক্তার তো এতক্ষণে ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। রিক্তার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল এক বন্ধুর জন্মদিনে, আমাদের এলাকাতেই বাসা। তারপর আরেকবার দেখা হয় ঐ বন্ধুর বোনের বিয়েতে। তারপর থেকে আমাকে মাঝে মধ্যে ফোন করে, টুকটাক এস.এম.এস দেয়। রিক্তা বহুবার, কখনো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কখনো বা সরাসরি আমাকে ওর সাথে ঘুরতে যাবার, সময় কাটাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এতদিন তেমন একটা পাত্তা না দিলেও আজকে চলে এসেছি। কারণটা ভাবতেই আমার একটু হাসি পেয়ে যায়।

মাথাটা ঘুরিয়ে আবার গেটের দিকে তাকাতেই রিক্তাকে চোখে পড়ল, সাথে কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব সহ বের হয়ে আসছে। আমি এগিয়ে গেলাম, ডাক দিলাম “এ্যাই রিক্তা!” সবাই ফিরে তাকাল। রিক্তাকে দেখে মনে হচ্ছে ও নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেনা।
-"আরে তুমি? কালকে তো ফোনে একবারও বললানা যে আজকে এখানে আসবা!"
-"ইচ্ছা করেই বলিনি। তোমাকে চমকে দিলাম।"
-"তাই নাকি?" ভ্রুকুটি করে রিক্তা। "স্ট্রেঞ্জ... এনিওয়ে পরিচয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে ফারিয়া, ও নীলু, এটা মেহরীন আর ও হল বিপাশা।" আমি সবার সাথে হাসিমুখে পরিচিত হলাম। হুমম ওর নাম তাহলে বিপাশা। মেয়েটা যে অদ্ভুত সুন্দরী আজকে আরও ভালমতো উপলব্ধি করলাম। সেদিন তো চোখ ছাড়া আর কিছু খেয়ালই করিনি। রিক্তা তো খুশিতে ঝলমল করছে যে আমি আজকে ওর সাথে দেখা করতে এসেছি। হায়রে, সত্যি কথাটা যদি জানত!! অন্য মেয়েগুলোর চোখে মুখেও বেশ মুগ্ধতার ছাপ দেখা যাচ্ছে। বিপাশার চোখের দিকে তাকাচ্ছিনা, বেসামাল না হয়ে যাই আবার। আর ওকে এখন বেশি পাত্তা দেয়াও ঠিক হবেনা, টেকনিক্যাল সমস্যা আছে।
-"রিক্তা চল, আজ আমরা সবাই একসাথে লাঞ্চ করব। না করতে পারবেনা, কারণ আমি জায়গা বুক করে এসেছি...”, আমি আবদার করলাম।
মেহরীন বলল ওর অন্য জায়গায় একটা জরুরী কাজ আছে, তাই সে যেতে পারবেনা। বাকীরা সবাই প্রথমে একটু আধটু আপত্তি করল, রিক্তাও চাচ্ছিল না মনে হয় অন্য কেউ আসুক আমাদের সাথে, কিন্তু আমার পীড়াপীড়িতে অবশেষে সবাই রাজি হল।

গাড়ি চালাচ্ছি, পাশে রিক্তা বসেছে, পিছনে অন্যরা। সবাই অনবরত কথা বলছে। রিয়ারভিউ মিররে হঠাৎ খেয়াল করলাম বিপাশা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কি আমাকে চিনতে পেরেছে? চিনলেও সমস্যা নেই। যে করেই হোক আমাকে আজকের পুরো সময়টা নিখুঁতভাবে কাজে লাগাতে হবে, একটাও ভুল করা যাবে না। আসার পথে শিমুলের ফিসফিস করে বলা কথাটা বারবার কানে বাজছে, "মামা, আমার তো আর তর সয়না... শালা কতদিন পর...!! " লোল টানার মত শব্দটা আবার করেছে শিমুল!

ব্যুফে রেস্টুরেন্ট টা অনেক নামকরা আর দামী। ম্যানেজার থেকে ওয়েইটার সবাই আমার পরিচিত। তাই ঢোকামাত্রই ম্যানেজার আমাদেরকে আমার বুক করা টেবিলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সবাই যে যার মতন বসে পড়ছিল, আমি টুক করে ফারিয়ার চেয়ারটা টেনে ধরে বসতে অনুরোধ করলাম। ফারিয়া হাসতে হাসতে বলল,
-"কি ব্যাপার? আমি ছাড়া তো এখানে আরও মেয়ে আছে, বিশেষ করে সুন্দরীদের কথা যদি ধরি।"
-"নীলু একটু উঠবেন? ফারিয়া চাচ্ছে আমি আপনার চেয়ারটাও টেনে ধরি", আমি গম্ভীর হবার ভাব করি।
-"আপনি তো দেখি কানা", ফারিয়া বলল।
-"স্বাভাবিক, ক্ষুধায় চোখে অন্ধকার দেখছি।"
সবাই হেসে উঠল। পরিবেশটা অনেকই সহজ হয়ে উঠেছে। পুরোটা সময় ধরে শুধু বিপাশাকে সযত্নে ইগনোর করে যাচ্ছি।

ঘণ্টা দুই পরে খাওয়া দাওয়া শেষে একে একে সবাইকে যার যার গন্তব্যের কাছাকাছি নামিয়ে দিচ্ছি। রিক্তার বাসার কাছাকাছি এসে গাড়ি পার্ক করে নামলাম। রিক্তা বের হয়ে ফিসফিস করে বলল, "থ্যান্ক ইউ রিশাদ, আমি কতটা খুশি হয়েছি তোমাকে দেখে, বলে বোঝাতে পারবনা। রাতে কথা হবে..."। তারপর বিপাশাকে বাই বলে হেঁটে চলে গেল।
এখন গাড়িতে রয়ে গ্যাছে শুধু বিপাশা, পিছনে সে চুপচাপ বসে আছে।
-"কি ব্যাপার আপনি বসে আছেন কেন? নামেন।”
-"মানে আমার বাসাটা তো আরেকটু সামনে, এই তিনটা গলির পর”, বিপাশাকে একটু অপ্রস্তুত দেখায়।
-"আমি আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেছি!”
বিপাশা অপমানে কাঁদবে না রাগ করবে বুঝতে পারছিলনা বোধহয়। গাড়ি থেকে নেমে গেল শক্ত মুখে। আমি সাথে সাথে ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটা খুলে ধরলাম।
-"আমাকে আপনার ড্রাইভার হিসেবে একদমই চিন্তা করতে পারছিলাম না”, আমার বহু সাধনায় রপ্ত মন ভুলানো হাসিটা উপহার দিলাম।
বিপাশা মানা করে দিল, সে এখান থেকে একাই চলে যেতে পারবে। আমি অনেক মাফ টাফ চাইলাম এইরকম মজা করার জন্য , অবশেষে সে আবার গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি স্টার্ট করলাম। কিছুক্ষণ পর বিপাশা বলল, "এত নাটকীয়তার কী দরকার ছিল?"
-"কী দরকার ছিল জানিনা। আপনার খারাপ লাগেনি তাতেই আমি খুশি।”
-"বাব্বাহ্‌ !! এত কনফিডেন্স নিজের উপর?" বিপাশা সোজা সামনে তাকিয়ে কথা বলছে।
-"মুখে শুধু একবার বলেন যে আপনার ভাল লাগেনি", ওর দিকে তাকালাম আমি, দেখলাম ঠোঁটের কোনায় একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠেছে। প্রাথমিক জয়ের আনন্দে ভিতরটা আবার শিরশির করে উঠল আমার।
-"আপনার চোখ কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর", সত্যি কথাটাই বললাম আমি।
-"তাই নাকি? কিভাবে বুঝলেন? আমার দিকে তো একবারও ভাল মতন তাকাননি আপনি।”
-"তার মানে সারাক্ষণ আমাকে খেয়াল করেছেন?"
বিপাশা লজ্জা পেয়ে গেল এবার। আমি বললাম, "আপনার সাথে তো এটাই আমার প্রথম দেখা না তাই না?"
-"হুমম...”, ওর ছোট্ট উত্তর।
-"তার মানে আপনার মনে আছে?"
-"হুমম আছে...”, বিপাশা আবার চুপচাপ।
ওদের বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি প্রায়। বললাম, "আপনাকে ফোন করব বিপাশা, নাম্বারটা দেবেন?"
-"এত তাড়াতাড়ি? দেখেন আমি আসলে সহজে কাউকে আমার নাম্বার দেইনা... জানেনই তো মেয়েদের অনেক সমস্যা হয়।”
-"জীবনে সব কিছুই তো কোন না কোন সময় প্রথমবারের মত করতে হয়....একবার সহজে নাম্বার টা দিয়েই দেখেন না হয়”, আমি হাসতে হাসতে বললাম।
-"আচ্ছা ঠিক আছে, আমার নাম্বার ০১৬১৫*****, এটা সবসময় আমার সাথে থাকেনা, শুধু রাতে অল্প সময়ের জন্য খুলি। আর শোনেন প্লিজ ১২ টার আগে ফোন দিয়েন, আমি ১২ টার পর রাতে কথা বলিনা।”
-"চিন্তা করবেন না, আমি এমনিতেও এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না। আমার ধৈর্য অন্যদের চেয়ে অন্তত ২৫/৩০ কেজি কম।”
কথা শুনে বিপাশা হেসে উঠল। সামনেই ওদের বাড়ির লাল গেটটা দেখা যাচ্ছে।



প্রায় চার মাস হতে চলল, বিপাশাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। এই কয় মাসে তেমন কিছু বদলায়নি, বদলেছে শুধু ও। এখন রাত ১২ টা কেন, সারারাত কথা বললেও বিপাশার আশ মেটেনা। দুই দিনের বেশি না দেখলে পাগলামি কান্নাকাটি করে। আমাকে কাছে পেলে একেবারে বাচ্চা হয়ে যায়। হাসে, প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ায়, সংসারের স্বপ্ন দেখে, কয়টা বাচ্চা হবে সেটা নিয়ে গাল ফুলিয়ে ঝগড়া করে। আমি সবকিছু সযত্নে সহ্য করি। কোন ভুল করা যাবেনা! শেষ সময়ে সামান্য একটা ভুলও সব কিছু ভেস্তে দিতে পারে। বিপাশা প্রায়ই বলে, "তুমি এত সুন্দর, এত ভাল। আমার ভয় হয় মাঝে মাঝে, হয়তো কোনদিন দেখব ঘুম ভেঙে গেছে আর আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।” আমি কিছু বলিনা। ওর চুলগুলোতে হাত বুলাই আস্তে আস্তে। বিপাশা আমার কাঁধে মাথা রেখে হেলান দেয়।
-"তুমি আমাকে যদি কখনো ছেড়ে চলে যাও, আমাকে আত্মহত্যাও করতে হবেনা জানো? আমি এমনিই মরে যাব”, ও প্রায়ই বলে একথা।
আমি মাথার ভিতর থেকে শিমুলের নোংরা হাসি শুনতে পাই। লোল টেনে টেনে হাসে, অসহ্য!! মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় আমার।

রাত ১১ টা বাজে এখন। বিপাশাকে ফোন করলাম। ধরেই ওপাশ থেকে বলল,
-"এ্যাই তুমি কি করে জান আমি কখন তোমার কথা ভাবি?"
-"এহ্‌ তুমি তো সারাক্ষণই আমার কথা ভাব... এর মধ্যে আবার জানাজানির কি আছে?"
-"আ-হা!! জ্বি না.... কক্ষনো না....”
-"শোন কাজের কথা, কালকে তো উইকেন্ড। অনেক দিন দূরে কোথাও যাইনা। চল কাল লং ড্রাইভে যাই, সাভারে আমাদের একটা ফার্ম হাউস আছে, তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি।”
-"ঠিক আছে, যাওয়া যায়, কিন্তু সারাদিন লাগবে তো, বাসায় কি বলব?"
-"কিছু একটা বানিয়ে বলে দাও, যেভাবেই হোক ম্যানেজ কর না।”
-"আচ্ছা আর কেও যাবে আমাদের সাথে?" বিপাশা জিজ্ঞেস করল।
-"নাহ, জামাতে লং ড্রাইভে যাব নাকি? কি যে বল না বল।”
-"ঠিক আছে, কখন যেতে হবে?"
আমি সাবধানে স্বস্তির একটা চাপা নি:শ্বাস ছাড়ি। যাক রাজি হয়েছে।
-"সকাল ৯ টায় বড় রাস্তার মোড়ে থেক। আমি তোমাকে তুলে নেব।”
-"আচ্ছা এখন রাখি তাহলে, ওই যে মা ডাকছে। আমি কথা বলে তোমাকে পরে কনফার্ম করছি। মিস ইউ আমার চড়ুই পাখি... উম্মা-হ্।”
-"ওকে বাই”, আমি রেখে দিলাম। এবার আগামীকালের জন্য একটু প্রস্তুতি নিতে হবে। পুরোদিন কিভাবে কি করব সবকিছু আরেকবার ভালমতো মাথার ভিতরে সাজিয়ে নিলাম। এতদিন ধরে একটু একটু করে সাজানো আমার অ্যালিবাই গুলো আবার চেক করলাম। নাহ্‌ সবকিছুই পারফেক্ট মনে হচ্ছে। আচ্ছা মেয়েটা বেশি কিছু চিন্তা না করে একেবারেই রাজি হয়ে গেল! ছেলেরা মেয়েদের কেন ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ি বা ফার্ম হাউসে নিয়ে যেতে চায় তা তো সবাই বুঝে আজকাল। প্রেমে পরলে মেয়েগুলা এত বোকা হয়ে যায় কেন কে জানে! নাকি বেশি মডার্ন, আমিই বুঝিনাই। যাই হোক আমার কাজ হলেই হল। ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে শুয়ে পরব ভাবছি যদিও জানি আজকে রাতে উত্তেজনা আর অস্থিরতায় ঘুম হবেনা। এই পর্যন্ত কখনো হয়নি। তাও নার্ভ ঠিক রাখতে হবে যথাসম্ভব, না হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারবনা।

পরদিন সাভারে পৌঁছতে পৌঁছতে ১১.৩০ বেজে গেল। ফার্ম হাউসের তালা খুলে ভিতরে ঢুকতেই বিপাশা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, আজ অবশ্য সকাল থেকেই তার মুড একটু বেশিই ভাল। যা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হচ্ছে। আমার ফার্ম হাউসটা অনেক বড় আর ছবির মত সুন্দর, একজন কেয়ারটেকার দেখাশোনা করে আর ২ জন গার্ড আছে। আজকে অবশ্য সবাইকে ছুটি দিয়েছি আমি। বিপাশাকে সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পুরোটা দেখালাম। এক পর্যায়ে বলল ওর খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। ওকে দোতলায় রেখে আমি পানি আনতে গেলাম। পানি নিয়ে ফিরে এসে দেখি সে রুমে নেই। ডাকলাম, "বিপাশা... এ্যাই বিপাশা.... কোথায় তুমি?"
-"আমি এখানে.... বারান্দায়... চলে আস।”
পানির গ্লাস নিয়ে বারান্দায় গেলাম। দেখলাম বিপাশা এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
-"এই নাও, ঠাণ্ডা পানি", পানির গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলাম।
-"থাক লাগবে না, ইচ্ছা করছেনা।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার কি খারাপ লাগছে নাকি?"
উত্তরে বিপাশা কিছু বললনা। দুইজনেই চুপ করে আছি। ও কি ভাবছে জানিনা। আমি ভাবছি কিভাবে আমার কাজ শুরু করব। এখন নাকি আরও পরে? একটু বেশি নার্ভাস লাগছে আজ, বেশ অনেক দিন পর তো!
-"আচ্ছা তুমি আমাকে ফার্ম হাউসে আনতে গেলে কেন?", বিপাশার প্রশ্নে আমি একটু থতমত খেয়ে যাই।
-"এমনিই। ভাবলাম এত সুন্দর একটা জায়গা আছে আমার, তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।”
-"চাপা মেরোনা। তুমি আমাকে কি ভাব? দুধের শিশু? ছেলেদেরকে আমি চিনিনা?" বিপাশার কণ্ঠে হালকা বিদ্রুপ।
-"এত সন্দেহ থাকলে আসলে কেন?? কাল তো বলা মাত্রই রাজি হয়ে গেলে। আজব!”, আমি বললাম।
-"কেন এসেছি জান? আমার একটু কাজ ছিল তাই। নিজে থেকে বলাটা আমার জন্য একটু কঠিন হয়ে যেত, কিন্তু তুমি বলায় আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গ্যাছে”, বিপাশা এবার ঘুরে আমার দিকে সরাসরি তাকালো, মুখে মুচকি মুচকি হাসি।
বিপাশাকে হাসলে অনেক অনেক সুন্দর দেখায়, আজকেও দেখাচ্ছে। ও কিছু সন্দেহ করেনি মনে হচ্ছে, করলে নিশ্চয়ই এত সুন্দর করে হাসত না।
-"আমি তোমার সাথে এসেছি কারণ তোমাকে একটু কাছে পেতে চাচ্ছিলাম, একেবারে নিজের করে। কেউ থাকবেনা আর, শুধু তুমি আর আমি।”
বিপাশা আমার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে, ওর চোখের দিকে এবার খেয়াল করলাম আমি, মনের সুপ্ত উদগ্র কামনা চরিতার্থ করার সুযোগ পেয়ে চকচক করছে।
হঠাৎ শিমুলের চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, উত্তেজনায় কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছে, "রিশাদ...এই সুযোগ। বেডরুমে নিয়া সুযোগ মত কাম তামাম কইরা দে...!!”
কিন্তু কেন জানি আমার একটু খুঁতখুঁত করছে মনের মধ্যে, কোথাও কি কোন গণ্ডগোল আছে? এসব ভাবতে ভাবতে দুই সেকেন্ডের জন্য একটু আনমনা হয়ে গেছি, এর মাঝে বিপাশা একদমই আমার কাছে চলে এসেছে, মুখে অদ্ভুত মিষ্টি দুষ্ট হাসি। কাছে এসে ও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ওকে জড়িয়ে ধরে এরপর কি করব না করব ভাবছি, হঠাৎ মনে হল আমার ডান দিকে পাঁজরের সামান্য নিচে কিছু একটা ঢুকে গেল। কি এটা? প্রচণ্ড ব্যথায় আমার গা গুলিয়ে উঠতে থাকে, মাথাটা হঠাৎ করে পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি বিপাশা আমার শরীরে একটা ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখি আমাকে ছেড়ে এক পা দুই পা করে পিছনে সরে যাচ্ছে আর হাহাহা করে হাসছে। আমার দৃষ্টি ক্রমশ: ঝাপসা হয়ে আসে। কোনরকমে কিছু একটা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, পারি না, পড়ে যাই। ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে রুমের দেয়ালের কাছে গিয়ে হেলান দিয়ে শুই। প্রচণ্ড হাঁপ ধরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে মগজটা বোধহয় এখনি নাকের ফুটো দিয়ে বের হয়ে আসবে। কোন রকমে যদি এ যাত্রায় বাঁচতে পারি... দেখতে পাই বিপাশা হাসতে হাসতেই পকেট থেকে চারকোণা একটা মডিঊল বের করছে, সাথে সাথেই জিনিসটা চিনতে পারি আমি। এটা আমারও একটা আছে, তার মানে... তার মানে হচ্ছে বিপাশাও আমার মত একজন ...


স্বয়ংক্রিয় ভাবে ক্যাপসুলের ঢাকনা টা খুলে যায়, ঘাড়ের পিছন থেকে সাইবারনেটিক কর্ডটা খুলে রাখে রিশাদ। সারা শরীর ঘামে ভিজে একাকার। নিজের বোকামির কথা মনে পড়ায় মনটা বিষিয়ে ওঠে প্রচণ্ড। এতদিনের পরিশ্রম, আট লক্ষ পয়েন্ট সব শেষ!! গলা ছেড়ে বিকট একটা হাঁক দেয়,
"কালাম, সিস্টেম রিস্টার্ট দে, আমি আবার প্রথম থেকে খেলব।”