জুড়ি

কৌস্তুভ অধিকারী


(গারট্রুড হাই বেইমার্স সঙ্কলিত চৈনিক উপকথার ছায়ানুবাদ)

চীনদেশের কোনো এক শহরে, সে অনেক কাল আগের কথা – ছিল এক পরমাসুন্দরী যুবতী, নাম তার শু। তার উপর আবার সে ছিল এক বেশ উঁচু বংশের কন্যা। ফলে তার আশেপাশে লেগেই থাকত গুণগ্রাহী যুবকদের ভিড়। আর সে বিষয়ে দারুণ হুঁশিয়ার ছিল শু, তার কথা ছিল, “পুরুষদের ব্যবহার করতে জানতে হয়, নইলে তারা কোনো কাজের না…”
অতএব তার জীবনযাত্রার একটা বড় সময়ই কাটত এইসব উৎসুক যুবকদের সাহচর্যে। তাকে প্রমোদভ্রমণে-নৈশাহারে নিয়ে যেতে পেরে তারা নিজেদের ধন্য মনে করত। আর শু’ও তার প্রতি এই মনোযোগ উপভোগ করত। তবে সে তার সান্নিধ্যপ্রার্থীদের এ কথাও জানিয়ে দিতে ভুলত না, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করতে গেলে, তার বর-অঙ্গ-সঙ্গলাভ করতে গেলে, তার প্রকৃত তুষ্টিবিধান করতে হবে – উপহার দিতে হবে বেশ মূল্যবান কিছু – আর তা যদি কোনো দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন মুদ্রা হয় তাহলেই সবচেয়ে উত্তম। এইভাবে সে গড়ে তুলেছিল এক বিশাল, ঈর্ষণীয় সংগ্রহ।

~o~

সেই শহরেই থাকত এক সাধারণ পরিবারের ছেলে, তরুণ মেধাবী ছাত্র চেং। এবং গল্পে চিরকাল যেমন হয়ে এসেছে, ফুলের বাজারে এক ঝলমলে সকালবেলা চেং’য়ের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে শু’য়ের উপর। যথারীতি, দেখা মাত্রই সেই যুবকের মনে দারুণ ইচ্ছা জাগতে থাকে, কমনীয় রমণীয় লোভনীয় এই ফুলটি তুলে এনে তার ছোট ঘরটি সাজাবার। মেয়েটির সাথে একবার আলাপ করবার জন্য খুব চেষ্টাচরিত্র করতে থাকে সে, এবং জানতে পারে তার সেই দুষ্প্রাপ্য মুদ্রার শখের কথা।
সে ভাবতে থাকে, তার ঠাকুমার কাছে প্রাচীন শান যুগের এক অত্যন্ত দুর্লভ মুদ্রা আছে বটে, কিন্তু নাতির খেয়ালের কথা শুনে কি আর তিনি ওটা তাকে দিয়ে দেওয়ার জন্য দেবেন? কখনোই না!
“প্রাণ থাকতে বুড়ি তা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না…” চেং ভাবে। হয়তো বা মরার সময় বড় নাতি হিসাবে তাকেই ওটা দিয়ে যাবেন, কিন্তু সে কথায় এখন কী লাভ? অথচ এখন ওই মুদ্রাটি পেলে, তার বদলে চেং আরো দুর্লভ একটি বস্তু হাসিল করতে পারত!
আরো মুশকিল এই যে, তার ঠাকুমার এই সম্পদটির খবর শু’য়ের কাছেও পোঁছেছে, কারণ সে আকারে-ইঙ্গিতে চেং’য়ের দূতকে জানিয়েছে, ওই মুদ্রাটি বিনা তো এই অল্পবয়সী ছাত্রের কোনো আশাই নেই, এমন এক বড় ঘরের মেয়ের কাছে ঘেঁষার।

~o~

অতএব আবেগ ও উদ্বেগের এক দারুণ জোয়ার-ভাঁটায় চেং’য়ের পড়াশোনা যায় তলিয়ে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু লিন এহেন অবস্থা দেখে প্রশ্ন করে, “ভাই, সত্যি করে বল, কী হয়েছে তোর?”
লিন দেখে, ব্যাপার বড়ই গুরুতর – ভালবাসা আর পড়াশোনার মধ্যে চিরাচরিত দ্বন্দ্ব এ নয়, যে বুঝিয়েসুঝিয়ে সামলানো যাবে – চেং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, শু’কে তার পেতেই হবে।
সে বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “চিন্তা করিস না, ও বড়লোকের মেয়ে তো কী হয়েছে, তুইও বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী ছাত্র; একটা উপায় নিশ্চয়ই হবে।”
তখন চেং আক্ষেপ করে শোনায় মুদ্রাঘটিত জটিলতার কথা। বলে,
“বুড়ি মরলে হয়ত ওটা আমার নামেই উইল করে যাবে, কিন্তু সে কবে হবে, তদ্দিন অপেক্ষা করে বসে থাকব? ততদিনে হয়ত শু’ই বুড়ি হয়ে যাবে…”
“আরে, তার মানে তো ওটা তোর প্রায় হয়েই আছে! একদিন ঘন্টা কয়েকের জন্য ধার নে না। শু’কে মুদ্রাটা দেখিয়ে প্রলুব্ধ কর, বল, আমাকে বিয়ে করলে ওটা একদিন তোমারই হবে। তাতেই কাজ হবে।”
“না না, ঠাকুমা ওটা যেমন যত্ন করে বাক্সের মধ্যে রেখে দেয়, কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও হাতছাড়া করতে রাজি হবে না। এভাবে হবার নয়,” হতাশ হয়ে বলে চেং।
“আরে বোকা, এত হতাশ হয়ে পড়ার কি আছে? প্রেমে পড়ে ইস্তক পড়ার বইয়ের সঙ্গে কি বুদ্ধিগুলোও সরিয়ে রেখেছিস? আসলটা উপহার দিতে না পারিস, নকলই দে না! চ্যাং’এর বাবা কামারশালার কারিগর, জানিস না নাকি?”

~o~

একদিন বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে চেং, ঠাকুমার কাছে গিয়ে বলে, লিন তাঁর প্রাচীন জিনিসপত্রের সংগ্রহ দেখতে খুব আগ্রহী। ঠাকুমা উৎসাহের সাথেই চাবির গোছাটি বার করে লাল চন্দনকাঠের কারুকাজ করা ভারী আলমারিটি খোলেন, একে একে দেখাতে থাকেন তাঁর সেইসব গর্বের ধন। এমনই যখন মিং যুগের চীনামাটির দুর্দান্ত ফুলদানিটি নিয়ে লিন ঠাকুমার সঙ্গে দারুণ আলাপ জমিয়ে ফেলেছে, এটা-ওটা নাড়াচাড়া করার ফাঁকে সেই মুদ্রাটি হাতে নিয়ে মোমের উপর ছাপ তুলে নেয় চেং।
দু’দিন পর চ্যাং খবর আনে, সীসার উপর সোনার জল করা একটি চমৎকার নকল মুদ্রা তার বাবা বানিয়ে ফেলেছেন। চেং তো আনন্দে আটখানা। তবে সেই সঙ্গে তার একটু ভয়-ভয়ও লাগতে থাকে, কে জানে, যদি অভিজ্ঞা শু এক নজরেই ধরে ফেলে, যে এটা নকল? যদি সে রেগে গিয়ে তার সঙ্গে আর কোনোদিন কথাই না বলে?

~o~

শু’য়ের কাছে খবর পাঠায় সে, দেখা করতে খুব আগ্রহী জানিয়ে। উত্তর আসে, সোমবার বিকেলে নদীর উত্তরের বাগানে হাজির থাকতে। সাড়া পেয়ে তো চেং’য়ের মনে আনন্দ আর ধরে না, ফিটফাট সেজেগুজে পারলে দুপুর থেকেই সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু হায়, বিকেলবেলা শু’র বদলে সেখানে উপস্থিত হয় তার পরিচারিকা। সেও এক রূপসী তরুণী, চলনে-বলনে লাস্যময়ী; তার চোখের কোণে হাসির ঝলক বুঝিয়ে দেয়, এই খেলায় সেও অভিজ্ঞা।
চেং’য়ের কানের কাছে তার রক্তাভ ঠোঁটদুটি এনে ফিসফিস করে বলে, “আজ রাত্রে যখন মাথার উপর চাঁদ উঠবে, যখন ঘুমিয়ে পড়বে সারা শহর, তখন আমাদের বাড়ির দরজা খোলা থাকবে তোমার জন্য…”
তার হৃদয়ের গতি যেন দ্রুত হয়ে যায় এই কথা শুনে। মেয়েটি বলতে থাকে,
“… উঠোনে এসে খিলানের নিচে দাঁড়াবে। ডানদিকের সারি সারি ঘরগুলির মধ্যে একটির জানালা থাকবে খোলা, আর জানালার পাশে ফুলদানিতে রাখা থাকবে লাল গোলাপ। তার পাশে তোমার আনা উপহারটি রেখো, আর ফিরে যেও খিলানের কাছে। যদি তোমার উপহার হয় মনোমত, তাহলে ঘরের দুয়ারটি খুলে সে তোমায় আমন্ত্রণ জানাবে সেই রাত্রির মত…” – ঠোঁটে তার লজ্জারাঙা হাসি।
“তবে…” সাবধানবাণী জানাতেও ভোলে না সে, “ছায়ার মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করবে, আর কোনো শব্দ করবে না। বাড়িতে কোথাও কোনো আলো জ্বলবে না। মনে থাকে যেন, ওই বাড়িতে সবারই ঘুম খুব পাতলা। সূর্য ওঠার আগেই তোমায় ফিরে যেতে হবে।”
“শু জানে, তুমি একজন ছাত্র কেবল, স্বভাবতই অনভিজ্ঞ আর অস্থিরমতি। তার উপযুক্ত প্রেমিক হবার মত যোগ্যতা তোমার এখনও নেই। তাই তোমার উপহার যদি সত্যিই পছন্দ হয়, তবেই ভবিষ্যতে আবার দেখা হবার সম্ভাবনা। নইলে, এ শহরে তো সুন্দর পুরুষের অভাব নেই।”
উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না সে, মুখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি এঁকে দ্রুতচ্ছন্দে চলে যায় সেতু পেরিয়ে।

~o~

সেই রাত্রে দুরুদুরু বুকে চেং অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সব নির্দেশ। চুপিসাড়ে সেই নিরিবিলি আঙিনায় এসে, জানালার পাশে তার উপহার রেখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে খিলানের তলায়।
একটু পরে তার মন পুলকে ভরিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে একটি দরজা খুলে যায়। চেং দৌড়ে যেতে যায় তার পানে, পরক্ষণেই সামলে নেয় নিজের আবেগ। লঘু পায়ে ছায়ার মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যায় সেই ঘরে। তারপর? স্বপনচারিণীর বহুকাঙ্খিত সান্নিধ্যে সে পরমানন্দে যাপন করে কয়েক প্রহর।

~o~

ভোরের মোরগ ডেকে ওঠার আগেই চেং বাড়ির পথ ধরে। সূর্য উঠতে তখনও দেরি, তবুও তার যেন মনে হয় এক নতুন রঙে সেজে রয়েছে চারিদিক। চুপিচুপি নিজের ঘরে ফিরে জানলার পাশে বসে সে একমনে গত রাত্রির মিষ্টিমধুর স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে।
যদিও মেয়েদের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা তার আগে কখনো হয় নি, তবুও তার মনে হতে থাকে, শু যেন সকল মেয়েদের সেরা। আক্ষেপ করে, কতদিনে সে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তাহলে তাকে এভাবে আর ছায়ার মধ্যে দিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে হবে না। শু’ও তখন তাকে যথার্থ গুরুত্ব দেবে। কিন্তু যদি না-ও দেয়, আর কোনোদিনও যদি সে তার সঙ্গ না পেতে পারে, তাহলেও গতকালের সুখস্মৃতি সে সারা জীবন ধরে বুকে ধরে রেখে দেবে গর্বের সাথে।

~o~

আনন্দে মেতে থেকে সে আর লিন’কে খবর দেওয়ার কথা মনে রাখে না। একা’একাই পৌঁছে যায় সেই ফুলের দোকানে, যেখানে সে প্রথম পেয়েছিল তার প্রেয়সীর সাক্ষাৎ। আজকে যেন ফুলগুলোকে দ্বিগুণ ঝলমলে মনে হতে থাকে, তার খুশির সঙ্গে মিলিয়ে যেন তারা সবাই হাসিখুশি। উৎফুল্ল মনে অপেক্ষা করতে থাকে সে, কখন শু’র পরিচারিকা এসে জানাবে পরবর্তী সাক্ষাতের দিনক্ষণ।
তাই সে যুগপৎ বিস্মিত এবং আনন্দিত হয়ে ওঠে, যখন দেখে স্বয়ং শু’ই মরালসঞ্চারে এগিয়ে আসছে তার দিকে। একমুখ হাসি নিয়ে চেং তাকে সম্ভাষণ করতে যায়, কিন্তু তার আগেই শু’র মধুর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় –
“গতকালের উপহারের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আশা করি আমার পরিচারিকা তোমার যথাযথ সেবা করেছিল…”
হতবাক হয়ে যায় চেং। ‘পরিচারিকা?’
ভেবে কূল পায় না সে, “কিন্তু… কাল রাত্রে… এত উৎসুক মনে হল… তোমায়… ওঃ… পরিচারিকা!”
হৃদয়বিদারক হাসির সঙ্গে শু বলে ওঠে, “বেচারা! আমার করুণা হচ্ছে তোমার উপর। তা, ঠাকুমা কি জানেন, তাঁর নয়নমণি ওই মুদ্রাটি কী করেছে তাঁর সোনামণি?”
“কিন্তু…”
উদ্ধত স্বরে বলে যেতে থাকে শু, “তুমি ভাবলে কি করে খোকা, যে আমার মত এক সম্মানিত মহিলা তোমার সঙ্গে মাখামাখি করবে?
বইখাতার বাইরের সমাজটার কোন ধারণা রাখো? এভাবে তোমার সঙ্গে এখানে কথা বলাও আমার পক্ষে অস্বস্তিকর, কোনো বাগানে বা অনুষ্ঠানে বেড়াতে যাওয়ার কথা তো ভুলেই যাও। আর কোনোদিন আমার বাড়িতেও ঢোকার চেষ্টা কোরো না, লোক ডেকে ধরিয়ে দিতে কেউ দ্বিধা করবে না।”
“বুঝলে,” একটু থেমে, ব্যঙ্গের সঙ্গে সে বলে চলে, “আমাকে পাবার আশা ছেড়ে দাও – একদিনের জন্য আমার পরিচারিকাকে পেয়েছিলে, আসলের পরিবর্তে সেই নকল নিয়েই বরং সন্তুষ্ট থাকো…”

~o~

এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে আসে চেং’য়ের। চমকের ঘোর কাটিয়ে সে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ তাইতো, ভাল কথা, আসল-নকলের কথা যখন তুললেই, জানিয়ে রাখি, আমার উপহার দেওয়া ওই ‘প্রাচীন’ মুদ্রাটি আবার কাউকে দেখিয়ে গর্ব করার চেষ্টা কোরো না যেন। ওটাও নকল, বিশ্বাস না হয় একটা ধার দাঁতে কামড়ে দেখে নিও।”
মুচকি হেসে শু’র বিভ্রান্ত মুখ একবার দেখে নিয়েই চেং তাকে পিছনে ফেলে চলে আসে, কোনো উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই।
আর একলা দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে ভাবতে থাকে শু, তার উপরেও কেউ এমন চাল দিতে পারে? “একমাত্র এমন ধূর্ত কেউ’ই হতে পারে আমার যোগ্য জুড়ি…”