বিনোদ ঘোষাল

 

রাত্তির হলে বারীন পালটে যায়। এমনিতে দিব্যি সারাদিন হাসিমুখে রিক্সা টানে। ভাড়া নিয়ে কোনও প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে কিচাইন করে না। ব্যাঙের পেচ্ছাপের মতো অথবা সত্যিই খুব বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় জল জমে গেলেও প্যাসেঞ্জারকে ভাড়া বেশি লাগবে কিংবা যাবো না বলে না। কিন্তু রাত্তির আটটার পর ও যখন রেললাইনের ধারে মেথর পট্টিতে ঢোকে, তখন থেকেই সারাদিনের বারীন পাল্টাতে শুরু করে। কচির ঝুপড়ির সামনে ব্যারেলে ভরা সাদাটে ঘোলা রঙের অমৃত ঝরতে থাকে মাটির খড়াই’গুলোর ওপর। সঙ্গে পেঁয়াজ আর বোঁটকা তেলের গন্ধওয়ালা ডালমুট। কখনো আরেকটু পকেট নরম করলে ঝাল ঝাল শুয়োরের মাংস। মাঝমধ্যে কচির বৌটাও আসে খড়াই ভর্তি করতে। উহহ দেখে কে বলবে মাইরি মেথরের বৌ! রোজ সকালে ঝ্যাঁটা-বালতি হাতে নিয়ে কচির সঙ্গে বাড়ি বাড়ি গু পরিস্কার করে। শালাহ বডি! পাঁচ-ছটা নেন্ডি-গেন্ডি বার করার পরেও হেইস্যা টাইট বুক, পিঠের দিকে ব্লাউজের ঠিক নিচুটায় যে দুটো সোহাগী চর্বির ভাঁজ আছে, হ্যারিকেনের আলোয় ঘামে ভেজা খয়েরি রঙের শরীলটায় ওই ভাঁজদুটো ইলিশ মাছের মতো চকচক করে। ওখানে নিজের মুখটা ডলতে ইচ্ছে করে বারীনের। ভাবলেই গোটা শরীর কেঁপে ওঠে…। কিন্তু কিস্যু করার নেই। কচি যা খতরনাক চিজ! একবার কে যেন ওর বউ এর হাত না কী ধরে ছিল নেশার ঘোরে। কচি পুরো এক ব্যারেল চুল্লু গায়ে ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছিল মালটাকে। ধুসস… একেবারে গলা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে বারীন ঢোঁক মারতে থকে খড়াইতে।

প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ আসর ভাঙার পর ও রিক্সা নিয়ে সোজা চলে আসে শিবুর মিষ্টির দোকানে। দোকানের শাটার তখন হাফ নামানো হয়ে যায়। বারীন নিচু হয়ে দোকানে ঢুকে রেলাসে একটা দু’টাকার কয়েন বাড়িয়ে দেয়। দোকানে শোকেসের ওপর কাঠের বারকোশে সাদা চিকচিক কাগজে চাপা দেওয়া বোঁদে একচামচ ঠোঙায় ভরে এগিয়ে দেয় শিবু। রোজের ব্যাপার, তাই কোনও কথার প্রয়োজন হয় না। এই বোঁদের নেশাটা বারীনের অনেক দিনের। সারাদিন কুত্তার মত খাটার পর বাড়ি গিয়ে শালা ঐ শুকনো রুটি আর কালচে আলুর চচ্চড়ি গলা দিয়ে নামে? হারামী বৌটা মাঝে মধ্যে একটু পরোটা-টরোটাও বানাতে পারে না। এই বোঁদেটুকুই তাই বারীনের সব। পাতে ঢালা বোঁদের ওপর স্রেফ তাকিয়ে ওই চিমসে রুটি আর ছ্যাকরা আলুর চচ্চড়িটা প্রায় গিলে মেরে দেয় ও। তারপর তারিয়ে তারিয়ে বোঁদেগুলো খেতে থাকে। ছেলেদুটো ঘুমিয়ে না পড়লে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বোঁদের ওপর। তখন বারীন ওদের চোখে শুধু বাপ নয়, রাজা। কখনো হঠাৎ কৃপা হয়ে গেলে বারীন ওদের দিকে একটু বাড়িয়ে দেয়। বেশি না, খুব জোর দু-চার দানা। ছোটটা আবার আহ্লাদে খাবি খেয়ে বলে ওঠে, আমি লাল গুলো খাব। বারীন পেল্লায় ধমক দেয়। ধ্যার গাধা কা বাচ্চা, লাল হলুদ স-ব সম..মান। যা দিচ্ছি, খা। আর টেমপার ঠিক না থাকলে চিৎকার দিয়ে বলে, হ্যাট্‌ শালাহ… ভিকিরির বাচ্চা… ঘুমো বলছি! …যত্ত শুয়োরের পাল এখেনে জুটেছে…! মুখ যত ছুটতে থাকে পাতের বোঁদেও শেষ হয়ে আসতে থাকে। খিস্তি থেকে গৌরীও বাদ যায় না। বাচ্চা দুটো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়, তারপর চোখ বুজে শুয়ে পড়ে। প্রায় রোজই এমন ঘটনা। তবু ছোট দুটোর ভয় পাওয়াটা এখনও অভ্যাস হয় নি কেন কে জানে? বাচ্চাদুটো শুয়ে পড়লে তখন বারীন গৌরীকে আছাড় দিতে শুরু করে। একেবারে বিছানায় শোয়া পর্যন্ত। গৌরী অদ্ভুত চুপ। হ্যারিকেনের হলুদ আলোটা ছোট্ট নীল রঙের বিন্দু করে দেওয়ার পরেও বারীন বিরামহীন। …শাল্লা এইতো চামচিকের মতন চেহারা… ছাগলের নাদির মতন বুক … দেখগে কচির বৌকে। ফিগার কাকে বলে। …শালাহ, এত্ত গেলাই তব্বু পিঠে ভাঁজ পড়েনা! ওপাশ ফিরে গৌরী শুধু সময় গুনতে থাকে। তারপর গলার ঝাঁঝটা ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করে বারীনের। নামতে নামতে শেষে একেবারে ভিজে ন্যাতার মত হয়ে যায়। …জানিই তো কিস্যু করতে পারি না তোদের জন্য… কী করব শালাহ… ঢ্যামনার কপাল…।

সময় শুরু হয়ে গেছে বুঝে গৌরী তখন আস্তে আস্তে বারীনের কাছে ঘেঁষে শোয়। ওর হাপরের মত বুকে হাত রাখে আলতো করে। বারীন ডুকরে বলে ওঠে, কালকে পরোটা বানাবি। আমি সব্বার জন্য পাঁ-চ টাকার বোঁদে নিয়ে আসব। অন্ধকারে নিঃশব্দে হাসে গৌরী। তারপর বারীন একটানে গৌরীর জামাটা খুলে ফেলে ওর বুকে হাত দেয় আর পাঁজরে লেটকে থাকা শুকনো পিঠে নিজের মুখটা ঘষতে থাকে। আশ্চর্য এক জলে গৌরীর পিঠ ভিজে যায়। …

এই রকম রাতটা নতুন কিছু নয়। প্রায় রোজই এমন প্রতিজ্ঞা চলে। কিন্তু সেই ‘কালকে’র দিনটা বলে যে কিছু নেই, গৌরী জানে। তবু ও নিশ্চিন্ত আরামে বারীনের বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে তখন। ভেতরটা কালীপূজোর রাত্রের মতন আলো আর আলোয় ভর্তি! সবাই জানে রাত্তির হলে বারীন পালটে যায়, কিন্তু শুধু গৌরী জানে অনেক রাত্তিরে বারীন আরো পালটে যায়।