অভিষেক মুখার্জী

 

শেষ অবধি অ্যামেরিকা আসা হল!
বাপ্‌রে বাপ, আসা তো নয়, যুদ্ধ!
ভিসার জন্য পাখিপড়া? করেছি।
শীতের সকালে এম্ব্যাসিতে দাঁড়ানো? করেছি।
ক্যুরিয়রের ভরসায় না থেকে ওম টাওয়ার্সে গিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসা? করেছি।
গজকুমারে গিয়ে দেশে ফিরে ইহজীবনেও পরব না এমন খান-চল্লিশ গরমজামা কেনা (ওখানে মাইনাস চলছে, মরে যাবি!)? করেছি।
শাশুড়ির চোখ এড়িয়ে স্যুটকেসের একদম নিচে গোটাকয়েক “ইয়ে” জামা পুরে নেওয়া (বাঃ, চেক-ইন করেই এয়ারপোর্টের বাথরুমে ঢুকে হল্টার-স্প্যাগেটি পরে অ্যামেরিকান সাজতে হবে না?)? করেছি।
বলরামে অর্ডার দিয়ে সন্দেশকে ফ্লাইটের জন্য স্পেশাল ডবল-প্যাক করা? করেছি।
ক্যারিঅন ব্যাগে নতুন সানন্দা আর আনন্দলোক ভরে নেওয়া? করেছি।

তারপর এয়ারপোর্ট। তার আগে অবিশ্যি পাসপোর্ট-টিকিট গোছানোর পর্ব; বিগ্রহর একটা বেল্টব্যাগ আছে (জানি, আরো নানারকম নাম আছে, কিন্তু বেল্টব্যাগ শুনতে ভালই লাগে); সেটা ও সাতাত্তরবার মিলিয়ে দেখেছে। পাশের বাড়ি থেকে ওজন নেওয়ার যন্ত্র নিয়ে এসে প্রত্যেকটা ব্যাগের ওজন মিলিয়ে দেখলাম (সঙ্গে নিজেরও – কত, সেটা আর বলছি না)।

লুফথান্সার চেক-ইন কাউন্টারের মেয়েটার সঙ্গে বিগ্রহের ফ্লার্ট করা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলাম (আহারে, ওখানে গিয়ে অনেক খসাব, বেচারা একটু করে নিক)।
তারপর অপেক্ষা।
বোর্ডিং।
“চিকেন অর পাস্তা”র উত্তরে “চিকেন” বলা (বেচারা বিগ্রহ চিকেন অ্যান্ড পাস্তা চেয়েছিল)।
মাইক্রোওয়েভে বারোশো ডিগ্রি বা ঐরকম কোনো তাপমাত্রায় মুরগি-আলুসেদ্ধ-কড়াইশুঁটি-গাজর একাকার করে বানানো ঘ্যাঁট গলাধঃকরণ করা।
ফ্র্যাঙ্কফুর্টে নেমে পানীয় জলের জন্য হাহাকার, আর তিন ইউরো দাম দেখে আঁতকে ওঠা।
আবার ফ্লাইট।
আবার ঘ্যাঁট।
পেছনের সিট থেকে জাপানী শিশুর লাথি।
সামনের সিট থেকে ব্রিটিশ বাচ্চার ফ্রুট লূপ খাওয়ার বায়না।
হাঁটু নাড়াতে না পারা নিয়ে বিগ্রহের ঘ্যানঘ্যানানি।
তার মধ্যেই ঘুম, আর তারপর… অনেক ঘণ্টা, অনেক বছর অপেক্ষার পর… অ্যামেরিকা। অবশেষে।

***

আগেই বলে রাখি, আমার এই অ্যামেরিকা-ফ্যান্টাসি অনেকদিনের। আমি কস্মিন্‌কালেও ইংরেজি বই পড়তাম না বা হলিউডি সিনেমা দেখতাম না, কিন্তু তাই বলে অ্যামেরিকা আসার স্বপ্ন তৈরি হবে না? জি আর ই দিয়েছিলাম, বেশ বাজে স্কোর হল, কাজেই একটা সফটওয়্যারের ছেলে দেখে ঝুলে পড়েছিলাম। কায়দা করে জেনে নিয়েছিলাম, অনসাইট যেতে হয় কিনা, কোথাও। ছেলেটা বুদ্ধিমান, ফরদিন খানের মত হ্যান্ডসাম, টাকা আছে বেশ, অনসাইটে আসে, সিএনবিসি দেখে, পার্টিতে গেলে দিব্যি শেয়ারমার্কেট নিয়ে কথা বলতে পারে, কয়েকটা বড় বড় ক্লাবের মেম্বর, অতএব দিব্যি প্রেমে পড়া যায়। পড়লাম, আর বিয়েও করে ফেললাম।
এবার, অ্যামেরিকা।

***

এবারেরটা অবিশ্যি অনসাইট নয়। এমনিই বেড়াতে আসা। তার মানে এই নয় যে হোটেলে থাকব। বিগ্রহের মাসির বাড়ি এডিসন, বেশ বড় বাড়ি। মাসি নিঃসন্তান, আর বেশ বড়লোক, আর বিগ্রহকে এতটাই ভালোবাসে যে না এলে রীতিমত সেন্টু খাওয়ার সম্ভাবনা। হাতে-হাতে কাজ করতে হবে ঠিকই, কিন্তু ঐ, অনেকগুলো টাকার সাশ্রয় হবে, ফিরে এসে একটা তনিশ্‌ক্‌ মেরে দেব সেক্ষেত্রে বিগ্রহকে পটিয়ে। ওখানেই থাকব, আর গাড়ি ভাড়া করে বা এন জে ট্রান্সিটে চড়ে নিউইয়র্ক-ফিলাডেলফিয়া-নায়াগ্রা-অ্যাটলান্টিক সিটি বীচ ঘুরে বেড়াব।

কাস্টমস পেরিয়ে পাঁচ ডলারের শ্রাদ্ধ করে ট্রলি নেওয়ার পর বিগ্রহ বলল, “মনে আছে তো?”
“কি?”
“মাসির কথা?”
“কি?”
“একি, বললাম তো…”
“ওঃ, সেই বাতিক? আরে হ্যাঁ, ভাবিস্‌না, ম্যানেজ করে নেব।”
“না, তুই বুঝছিস্‌না…”
“চিল্‌।”

***

বিগ্রহর মেসো বেশ অমায়িক গোলগাল লোক। গোল মুখ, গোল মসৃণ টাক, গোল সলিড ভুঁড়ি, গোল চোখে গোল চশমা, গোল আঙুলে গোল নখ, গোলগলা টিশার্ট, এমনকি গোল গোল জুতোও। আমাদের দেখে একগাল হেসে বললেন, “বাঃ, তোমাদের বেশ কম লাগেজ তো!”
বিগ্রহ বলল, “হ্যাঁ, তবে সোমদত্তাকে তো চেনোনা, ফেরার সময় এই পাঁচটা ব্যাগ ন’টা হয়ে যাবে।”
এবার কিছু না বললেই নয় – “সেই; পাঁচটা ব্যাগের চারটে তো তুই ভরিয়েছিস্‌।”
“ও, তোর পুরো কস্মেটিক্স রেখে এসেছিস্‌?”
বাড়ত নির্ঘাত। মেসো নিজেই লাগেজ বুট-এ (ডিকি নয়, বুট: আমাকে পইপই করে শেখানো হয়েছে) তুলতে শুরু করায় আমরা হাত লাগাতে বাধ্য হলাম। বড় অডি ভ্যান (আমি নিশ্চিত যে মেসো অডির লোগো দেখে লোভ সামলাতে পারেননি) – স্কর্পিও-কোয়ালিস ভুলে গেলাম এক নিমেষে।

“ইয়ে, সোমদত্তা, বিগ্রহ তোমাকে কি বলেছে জানি না, কিন্তু তোমার মাসির একটু অদ্ভুত স্বভাব আছে; আমি সঙ্গে থাকি, ব্যাপারগুলো জানি। তুমি তো জানো না, তোমার অদ্ভুত লাগতে পারে।”
“আপনি এইভাবে বলছেন কেন? উনি একটু পরিষ্কারভাবে থাকতে ভালবাসেন – তা সে তো অনেকেই চায় পরিষ্কার থাকতে।”
“না, ওর ব্যাপারগুলো একটু বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে যায় মাঝেমধ্যে।”
“যেমন?”
উনি মুচকি হেসে একটা গোল বাব্‌লগাম মুখে দিলেন। আমাদের অফার করলেন, তারপর বললেন, “চলো, দেখবে।”

***

ওয়ালমার্টের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। আমরা ঢুকলাম পেছন পেছন। বললেন, “বাড়িতে পরার জুতো নাও।”
ঘাবড়ে গেলাম। “কেন? আমাদের তো আছে।”
বিগ্রহও দেখলাম রীতিমত ঘাবড়েছে – “এখানে আবার বাড়িতে আলাদা জুতো পরে নাকি কেউ?”
মেসো এবার হেসেই ফেললেন, একটা সবে-তো-শুরু গোছের হাসি।

কিনলাম। বিগ্রহর খুব খিদে পেয়েছিল, আর ভেতরেই ম্যাকডনাল্ড’স, তাই খেতে ঢুকলাম। মেসো দেখলাম ডিক্যাফিনেটেড কফি খেলেন, নন-ডেয়ারি হোয়াইটনার আর শুগার-ফ্রি সুইটনার দিয়ে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে আমার বেশ হাসি পেল। উনি বুঝলেন, বুঝে নিজেও হেসে ফেললেন।
জিজ্ঞেস করলাম, “মাসির জন্য কিছু নেব না?”
“না।”
“কেন?”
“ও ম্যাকডনাল্ড’স-এ খায় না।”
অদ্ভুত লাগল। “কেন?”
“১৯৯৬-এ একজন ওয়েট্রেস গ্লাভস না পরে সার্ভ করেছিল। তারপর থেকে।”

***

বিগ্রহর মাসি বেশ সুন্দরী ছিলেন এককালে। মানে, বেশ ট্র্যাডিশনাল ধরনের; ফরসা, ধারালো চোখমুখ, পাতলা ফ্রেমের চশমা। অস্বস্তিকর ব্যাপারটা হল, ভুরু সবসময়ে কুঁচকেই থাকে, আর মুখ হাসলেও চোখ হাসে না।
আমরা ব্যাগ নামালাম; গেট অবধি নিয়ে গেলাম। দেখি, দরজার ঠিক মুখে বিশাল তিনতলা ট্রলি অপেক্ষা করছে, প্রত্যেকটা তাক প্লাস্টিকে মোড়া। একটু ঘাবড়ালাম।
মেসোর দিকে তাকিয়ে দেখি, মুখ টিপে হাসছেন। বললেন, “এটা এবাড়ির সিস্টেম – বাইরের কেউ থাকতে এলে ব্যাগ ট্রলিতে তোলা হয়, তারপর তার ঘর অবধি নিয়ে যাওয়া হয়। লাগেজের চাকার ধুলো বাড়ির মেঝেতে লাগে না।”
বিগ্রহর দিকে তাকিয়ে দেখি, নার্ভাস হাসি হাসছে। লাগেজ তুললাম। ততক্ষণে মাসি প্যাকেট খুলে নতুন জুতো বাড়ির ভেতরে রেখেছেন। মেসোর চটিও রেডি, উনি বাইরের জুতো বাইরে খুলে অদ্ভুত কায়দায় লাফ দিয়ে সোজা বাড়ির চটির ওপর ল্যান্ড করলেন।
আমি অত বুঝিনি। জুতো ছেড়ে হেঁটে ঢুকলাম ভেতরে। মাসি গম্ভীর।
“দেখো সোমদত্তা, এই বাড়ির একটা নিয়ম আছে। বাইরের পায়ে তুমি ভেতরে ঢুকতে পারো না। বাইরে যাও, আবার হেঁটে ঢোকো।”
ঘাবড়ে গিয়ে পেছোলাম, কয়েক পা। মাসি ভেতরে গেলেন। তখনও বুঝিনি, কি হতে চলেছে। এলেন, মিনিটদুয়েক পর। একহাতে টয়লেট রোল, অন্যহাতে একটা বড় শিশি। ওপরে লেখা লাইসল।
লাল কার্পেট পাতা হতে দেখিনি কখনো। তবে কিভাবে হয়, জানলাম। টয়লেট পেপার বিছিয়ে দিলেন মাসি, আমার পা থেকে আমার বাড়ির চটি অবধি (তখনও জানিনা, ওদের ফ্লিপফ্লপ বলে), আর গুছিয়ে অনেকটা লাইসল ঢাললেন।
“এবার এসো।”

***

“ট্রলি তোমাদের ঘরে নিয়ে যাও। আনপ্যাক করো, কিন্তু ব্যাগসমেত ট্রলি ঘরের বাইরে বের করে দাও।”
দিলাম, কিন্তু কৌতূহলবশতঃ গেলাম দেখতে, ব্যাগেদের কি গতি হয়।
বিশাল বাড়ি, যাকে অরুণোদয় “প্রাসাদোপম” বলত (আমার প্রথম প্রেমিক, বাংলায় লেটার পেয়েছিল, কিন্তু চাকরি পেতে দেরি করে ফেলল – বেচারা!) – অনেকগুলো গেস্টরুম। তার একটায় ট্রলি ঢুকল, আমাদের লাগেজ সমেত। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, মেসো ব্যাগগুলো বাথটাবে রাখলেন, আর বাথটাব জল দিয়ে ভরতি করে লাইসল ঢাললেন।
“এগুলো থাক এখন। ঘন্টাখানেক পর শুকিয়ে নেব। তোমাদের ঘরে লন্ড্রি ব্যাগ আছে, জামাকাপড় ওখানেই ছাড়বে। ওয়াশিং মেশিন দেখিয়ে দিচ্ছি।”
এত বড় ওয়াশিং মেশিন আমার চোদ্দগুষ্টিতে কেউ দেখেনি। “কমার্শিয়াল,” বিগ্রহ বলল। মেসো বললেন “হ্যাঁ, কিন্তু তাও পঁয়ত্রিশ মিনিটই নেয়। তোমাদের কোনো ধারণা নেই আমাদের ইলেকট্রিক বিল কত আসে।”
“এটা চালায় কে?”
“তোমাদের মাসি। দেখে বুঝতে পারবে না, কিন্তু ওর গায়ে বেশ জোর। অনেক ভারি কাজ এই বয়সেও একাই করে।” আবার মুচকি হাসি।
মেসোকে বেশ পছন্দ হয়ে গেল আমার, ইতিমধ্যেই। যেকোনো মানুষের পক্ষেই এই শুচিবায়ুগ্রস্ত মহিলার সঙ্গেই থাকা বেশ কঠিন, তাও চুয়াল্লিশ বছর ধরে; আর ইনি যে শুধু আছেন তাই নয়, সেন্স অফ হিউমরও অক্ষুণ্ণ আছে। ক্ষমতা আছে ভদ্রলোকের। আমি হলে কোন্‌কালে…

***

“বিগ্রহ?”
“ম্‌ম্‌ম্‌ম্‌?”
“এখানেই থাকতে হবে, নারে?”
“তুই হোটেলে থাকতে চাস্‌?”
“টাফ্‌ না, এখানে?”
“টাফ্‌ তো বটেই। কি করবি, কাল শিফ্‌ট্‌ করে যাবি?”
“না, থাক, অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। কটাই বা দিন? আর ওঁরা তো লোক ভালই। থেকেই যাই, একেবারে না পারলে দেখা যাবে নাহয়।”
“শিওর?”
“হুঁ।”
“তাহলে এখন?”
“এখন দেখব, যে তোর নাম রেখেছে, ঠিক রেখেছে, না ভুল।”
“মানে?”
“মানে, তোর নামের শুরুতে বিগ আর গ্রো কেন?”
“উফফ, এতটা জার্নি করে এলি, তোর কোনো ক্লান্তি নেই?”
“তুই ঐ শুয়েই থাক। বিগ্রহ হয়ে।”

***

“এই, সোমদত্তা?”
“হ্যাঁ মাসি?”
“ছটা ডিম স্ক্র্যাম্বল করে দিবি?”
“দিচ্ছি।”
এ ক’দিনে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি, মাসির রান্নাঘরে। ছেচল্লিশ বোতল লাইসল দেখার শক্‌ কেটে গেছে। অ্যাপ্রন, গ্লাভস, লাইসল, সবেতেই। ডিশওয়াশার থেকে প্যান বের করলাম, ডিম ফেটালাম।

“ডিমগুলো ফেলে দে।”
“ফেলে দেব? মানে?”
“তুই খেয়াল করিস্‌নি, প্যানের হ্যান্ডলে একটা মাছি বসেছিল, তুই বের করার পরেই। তুই ঐ হ্যান্ডল ধরেছিস্‌, তারপর সেই হাতেই ডিম ফেটিয়েছিস্‌।”
“তাই বলে…”
“দিবি।”
দিলাম।
“এবার প্যানটাকেও।”
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে আছি দেখে মাসি নিজেই এসে ফেললেন, প্লাস্টিকে মুড়ে (“মুড়ে ফেলছি কেন জানিস্‌? আবার মাছি বসবে, আর ঘরময় উড়বে?”), তারপর নতুন প্যান, নতুন ডিম বের করলেন।
“সর্‌, আজ আমিই করছি।”

***

ওয়ালমার্ট।
“কি করছিস্‌, সবজিগুলো ট্রলিতে রাখছিস্‌?”
“কিনছি তো আমরা। কোথায় রাখব?”
“হাতে বইবি। আমিও তো বইছি, এই বয়সে। পারবি না?”
“কিন্তু কেন বইছ?”
“আরে, এই ট্রলিগুলোয় এরা বাচ্চাগুলোকে বসায় না? ওরা তো বাথরুম করে। অনেকসময় ডায়পার ভিজে ভারী হয়ে যায়, তখন লিক করে। সেগুলো ট্রলিতে লাগে। তুই ভাবছিস্‌ ট্রলিগুলো তারপর এরা পরিষ্কার করে?”
আমি হতবাক্‌।

ফিরে এলাম। ফ্রিজে তুলতে যাব সব, এমন সময়… “কি করছিস্‌?”
“ফ্রিজে তুলব না?”
“না মেজে?”
“কি মাজব?”
“দেখাচ্ছি।”
ডিটার্জেন্ট আর স্কচ ব্রাইট নিয়ে শুরু করলেন। প্রথমে ডিম। প্রত্যেকটা ডিম নিখুঁতভাবে মাজলেন, অনেক সময় নিয়ে। তারপর সবজি – টোম্যাটো, ফুলকপি, বেগুন, ব্রকোলি, জুকিনি, মাশরুম, অসম্ভব মমত্ববোধের সঙ্গে। তারপর তুলে রাখলেন। হ্যাঁ, অবশ্যই সার্জিকাল গ্লাভ্‌স্‌ পরে।

***

এইভাবেই চলল। এই ফাঁকে কয়েকদিন ট্রেন ধরে (যার ভিড়, বিগ্রহ বলল, বনগাঁ লোকাল-এর থেকে কোনো অংশে কম নয়) নিউইয়র্ক ঘুরে এলাম। আরেকদফায় ফিলাডেলফিয়া। আরেকবার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, আইনস্টাইনের বাড়ি ইত্যাদি। ভাগ্যিস একে বিয়ে করেছিলাম!

***

দেখতে দেখতে উইকেন্ড এসে গেল। মেসোর ব্যালকনি পরিষ্কার করার দিন। বাড়ি কার্পেটে মোড়া হলেও ব্যালকনি নয়। ওখানে বাড়ির জুতো পরে যাওয়া যায়, কিন্তু পরিষ্কার ব্যালকনিতে। পরিষ্কার হবে কিভাবে?
মেসো দু’পায়ে দুটো বড় গ্রোসারির প্লাস্টিক পরে নিলেন, তারপর রাবারব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নিলেন। এইভাবে তৈরি মোজা পায়ে হেঁটে ভ্যাকিউম ক্লিনার চালালেন। তারপর ভ্যাকিউম হয়ে গেলে এই অদ্ভুত মোজা খুলে বাড়ির চটি।

মাসি লাঞ্চের জন্য ডাকলেন।
মেসো বললেন, “তোরা নিচে যা, আমি আসছি।”
লিভিংরুমে বসলাম। টিভি চালালাম (অবশ্যই টিস্যুতে আঙুল মুড়ে, নয়ত রিমোটে জীবাণু লাগতে পারে), চ্যানেল বদলালাম। হঠাৎ…

সাংঘাতিক জোরে শব্দ। লাফিয়ে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি, মেসো সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়েছেন, নিচে। উপুড় হয়ে। বিগ্রহ ওঁকে সোজা করল। ক্রিম কার্পেট রক্তে লাল, কপাল কেটে রক্ত গড়িয়ে নেমেছে গালে, গলায়, বুকে। সাদা গেঞ্জি রক্তে মাখামাখি।
জ্ঞান নেই।
বিগ্রহ একলাফে ৯১১ ডায়াল করল।

“তোরা একটু যা। আমি তোর মেসোর মুখ-টুখ একটু পরিষ্কার করে দিই।”
আমার বেশ বিরক্তিকর লাগল – এখনো পরিষ্কারের কথা মাথায় ঘুরছে? কিধরনের মানুষ?
মেসোর দিকে তাকিয়ে কষ্ট হল। ভদ্রলোক বেশ হাসিখুশি ছিলেন, হঠাৎ করে কি হল?
“কি হল, যা না!”
বিগ্রহও দেখলাম, বলল, “স্নো হয়েছে, আমি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই বরং। তুইও আয়।”
গেলাম। ও দেখি বেশ বিরক্ত।
“রাগছিস কেন?”
“রাগব না? এইর’ম পাগল জানলে আসতামই না, সোমা।”
“না এলে আজ কি হত ভাব?”
“সেই।”
হাত ধরে দাঁড়ালাম।

***

অ্যাম্বুলেন্স এল। চট্‌পটে তৎপর লোকজন, কলকাতার অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে মিলই নেই। এসেই জিজ্ঞেস করল, আহত ব্যক্তি কোথায়?
ভেতরে গেলাম। দেখি, মাসি একা, ব্লিচ দিয়ে কার্পেট মুছছে।
“মাসি? মেসো কোথায়?”
“বললাম না? মানুষটাকে তো পরিষ্কার করতে হবে। একটু ভালোভাবে না করলে হয়?”
“ওরা এসে গেছে, কোথায় মেসো? ওরা নিয়ে যাবে তো!”

মাসি উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের দেওয়া টেব্‌লক্লকটার দিকে তাকালেন।
“সবে তো দশ মিনিট হল রে। এখনও মিনিট পঁচিশ। একবার দেখে আসবি, কতক্ষণ বাকি?”