প্রতাপ সেন চৌধুরী

 

মানুষের জীবনে অতীতে এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যা কখনো কখনো তার ভবিষ্যৎ জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এরকমই একট ঘটনা প্রদীপের জীবনে ঘটেছিল।

*****

প্রদীপ চ্যাটার্জি, বর্তমানে বয়স ৬৫। দুর্গাপুর ইস্পাত প্রকল্প থেকে গত পাঁচ বছর হোল অবসর নিয়েছে। সফল মানুষ, এক মেয়ে ও এক ছেলে। চাকরী থাকতেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ছেলে অপেক্ষাকৃত ছোট, বিয়ে হয়নি এখনো, কলকাতায় থেকে চাকরী করে।

চাকরী থাকাকালীন প্রদীপ বর্ধমানে বাড়ীও করেছে। বর্ধমানে বাবর বাগ-এ বেশ ফাঁকা জায়গাতেই বাড়ীটা। সামনে বড় রাস্তা। দোতলা বাড়ী, নীচে গ্যারেজ। বেশ শান্তিতেই স্ত্রী সুমিতাকে নিয়ে ছিল। অবসরের পর সময় কাটানোর জন্য বই পড়া, লেখা আর ইন্টারনেটকেই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু একদিন –

প্রদীপ হঠাৎ করেই দেখেছিল ছেলেটাকে। চাকরী থাকতে একটা গাড়ী কিনেছিল – টাটা ইণ্ডিকা। গাড়ীটা অনেকদিন সার্ভিসিং করানো হয়নি বলে একদিন সকালেই টাটা মটরস এর সার্ভিসিং সেন্টারে নিয়ে গেল গাড়ীটাকে। গাড়ীটাকে দাঁড় করাতেই যে ছেলেটি প্রথমেই এগিয়ে এল তাকে দেখেই চমকে উঠল সে। ছেলেটি যেন তারই ছোটবেলার প্রতিমূর্তি। কি করে এমন হল? – একটু আনমনা হয়ে গেল সে।

হঠাৎ ছেলেটির কথায় সম্বিত ফেরে। ‘স্যার, গাড়ীর কি হয়েছে?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে। আনমনা হয়েই প্রদীপ বলে, ‘সার্ভিসিং করতে হবে।’ ছেলেটির পেছনেই মালিক তারাপদ বাবু আগিয়ে এলেন, উনি বহুদিনের পরিচিত, বললেন, ‘কি ভাবছেন? ওকে আগে দেখেননি তাই? ও আমার কাছে মাস তিনেক হল এসেছে, ওকে নিঃসঙ্কোচে আপনি গাড়ী দিতে পারেন, ও খুব ভাল মিস্ত্রী।’

ছেলেটিকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দিয়ে মালিকের সামনে গিয়ে বসল সে। ‘চ্যাটার্জি সাহেব, আপনি তো বহুদিন পরে এলেন, বসুন, চা খান।’ চা খেতে খেতে প্রদীপ তারাপদ বাবুর কাছ থেকে জানল যে ছেলেটি নাকি অনেক দূর থেকে আসে, শিক্ষিত ছেলে, স্কুল ফাইনাল পাশ। অটোমোবাইলে আই টি আই পাশ, টাটাতে ট্রেনিংও করেছে। নাম বাসুদেব। এর মধ্যেই বাসুদেব বলে গেল গাড়ী হতে দু’দিন সময় লাগবে।

‘তাহলে আজ আসি,’ বলে সে রিক্সা নিয়ে বাড়ী চলে এল। বাড়ীতে এসে খবরের কাগজটা নিয়ে বারান্দায় এসে বসে। কিন্তু কাগজ পড়ায় মন না দিয়ে সে ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে নিজের যৌবনের চেহারাটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে – লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট, দোহারা চেহারা, চুল কোঁকরানো, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, নাক মুখ চোখা, সব কিছু মিলিয়ে এক স্বাতন্ত্র্য ছিল তার চেহারায়। এইজন্য কলেজ জীবনে সবার প্রিয় ছিল, ইউনিয়নের নেতাও ছিল সে। আজ বাসুদেবের মত একটা আদিবাসী ছেলের মধ্যে সেই একই ছবি; কি করে সম্ভব? এরইমধ্যে সুমিতা তাড়া দিয়ে গেল, ‘এবার ওঠ, বেলা তো হল! স্নান খাওয়া করতে হবে তো, নাকি?’ ঘড়িতে দেখল প্রদীপ একটা বাজে। কাগজ একপাশে সরিয়ে রেখে উঠে স্নান করতে গেল সে। অবসরের পর থেকে দুপুরে একটা ভাতঘুম দেবার অভ্যাস হয়ে গেছে।

*****

আজ শত চেষ্টা করেও দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। বার বার ছেলেটার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কে এই বাসুদেব? পরের দিন সকালে আর সে স্থির থকতে না পেরে আবার সেই সার্ভিস সেন্টারে গেল। তারাপদ বাবু দোকানে ছিলেন না, বাসুদেবই এগিয়ে এসে বলল, ‘আজ তো গাড়ী হয়নি স্যার, কালকেই তো বললাম দু’দিন লাগবে।’ প্রদীপ হেসে বলল, ‘গাড়ী নিতে আসিনি, তোমার সঙ্গে আলাপ করব বলে এলাম।’ বাসুদেব কি বুঝল কে জানে, একটা টুল এনে সামনে বসল। সে ওকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কোথায় থাক?’ বাসুদেব বলল, ‘পানাগড়ের কাছে টেন্ট গেটে।’ ‘তোমার বাবার নাম?’ ‘সহদেব মুর্মু। বাবা মারা গেছেন। মা ওখানে সুইপারের কাজ করেন।’

এই কথা বলে সে উসখুশ করতে লাগল। প্রদীপ বুঝতে পারল মালিক আসার সময় হয়েছে, কাজ করতে হবে, তাই ও ওরকম করছে। প্রদীপ ওকে ছেড়ে দিল – বলল, ‘যাও, কাজে যাও।’

*****

বাড়ী চলে এল সে। বাসুদেবের দু’টি কথা তার কানে বাজতে লাগল – টেন্ট গেট আর সহদেব। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সুমিতা বলল শপিং করতে যাবে। তবে প্রদীপকে যেতে হবে না, ও পাশের বাড়ীর মহিলার সঙ্গেই যাবে। প্রদীপ একটু স্বস্তি পেল কারণ ও নিশ্চিন্তে একটু ভাবতে পারবে।

শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে লাগল, এই কি সেই সহদেব? স্মৃতির পাতা থেকে পঁচিশ বছর আগের একটা রাতের কথা তার চোখের সামনে ভেসে এল। তখন দুর্গাপুরে ইস্পাত প্রকল্পে কাজ করত।

সেদিন ছিল ছুটির দিন, পরের দিন ছিল নাইট ডিউটি। পৈতে উপলক্ষে এক সহকর্মীর বাড়ী গলসীতে নেমন্তন্ন ছিল। অল্প বয়েস, সবসময় বাইক নিয়েই যেত। গলসীতেও তাই গিয়েছিল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বেরোতে প্রায় সন্ধ্যা। ফেরার জন্য প্রদীপ বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তখন জিটি রোড হাইওয়ে হয়নি। তাই বেশী জোরে গাড়ী চালানো সম্ভব ছিল না। আস্তে আস্তেই আসছিল সে। কিন্তু পারাজ আসতে না আসতেই কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে এল। শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়, তবুও কোনরকমে সে এগিয়ে যেতে লাগল, ভাবল যদি পানাগড় পর্যন্ত যেতে পারে তবে নিশ্চিত আশ্রয় পাওয়া যাবে। কিন্তু বিধি বাম, টেন্ট গেট যেতে না যেতেই বিদ্যুৎ চমকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। ঠিক টেন্ট গেটের কাছেই একটা ছোট চায়ের দোকান অর্ধেক ঝাঁপ নামানো ছিল। গাড়ীটাকে দোকানের পাশে দাঁড় করিয়ে ঐ ঝাঁপের তলায় মাথা গলিয়ে দিল। দোকানদার আদিবাসীই হবে বোধহয়, বলল, ‘বাবু আরও ভিতরপানে আসুন, ওখানে জল আটকাবেক নাই।’ প্রদীপ ভেতরে ঢুকে এল, ঢুকে দেখল ও আর দোকানদার ছাড়াও আরেকজন আছে, এক অল্পবয়সী আদিবাসী বউ, দোকানদারের বউই হবে। বলল, ‘লক্ষ্মী, বাবুকে চা দে, একেবারে ভিজে গেইছে।’ লক্ষ্মী চা দিয়ে গেল। সে দেখল দোকানদার মাঝবয়সী হলে কি হবে, বউ তার যুবতী। এবার ভাল করে তাকে দেখল প্রদীপ। একজন শিল্পী নিখুঁত ভাবে কালোপাথরে খোদাই করে একটা নারীমূর্তি তৈরী করলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি সে। চেহারায় যৌবনের জোয়ার, কষ্ঠিপাথরের মত কালো শরীর চকচক করছে, ঢিলে করে পড়া ব্লাউজের উপর আঁটসাট করে লাল শাড়ী পড়া, নিখুঁত নাক মুখ চোখ, একরাশ চুল খোঁপা করে বাঁধা। চেনা জগতের বাইরে এক অনাবিল বন্য সৌন্দর্য দেখছিল সে। নির্লজ্জের মত তাকিয়ে আছে দেখে লক্ষ্মী একটু হাসল, ‘বাবু, বিস্কুট!’ ঘাড় নেড়ে সায় দিতে হাসতে হাসতেই বিস্কুট দিয়ে গেল সে। আবার ও দেখল প্রদীপ দাঁতের সাড়িও নিখুঁতভাবে সাজানো, যেন একরাশ মুক্তো ঝরে পড়ল।

বাইরে উঁকি মেরে দেখল তখনো সমানে বৃষ্টি পড়ছে। পকেটে ঘড়ি ছিল, বার করে দেখল রাত আটটা বাজে।

এর মধ্যে দোকানদারের সঙ্গে আলাপ করে জানল তার নাম সহদেব মুর্মু, আর্মিতে সুইপারের কাজ করে। বাইরের দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখল। মিশকালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে জিটি রোড, ঐ বৃষ্টির মধ্যেই অন্ধকারের বুক চিরে দু’একটা লরী ধেয়ে চলেছে। আর কোন যানবাহন চলছে না। প্রদীপ কি করবে বুঝতে পারল না।

সহদেবের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল, দেখে খারাপ লোক বলে মনে হল না। সহদেবকে বলল, ‘এখানে রাত্রীটা থাকার মত কোন ব্যবস্থা হবে?’ সে কিছুক্ষণ ভেবে জানাল যে আশেপাশে কোন হোটেল নেই, কষ্ট করে থাকতে পারলে টেন্ট গেটের ভিতরে তার কোয়ার্টার, পাশের কোয়ার্টারে এক বিহারী থাকে, কার্পেন্টার, দেশে গেছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে। যাই হোক এক রাতের তো ব্যাপার, চলে যাবে – এই ভেবে সে সহদেবকে একশ’ টাকার নোট দিল, বলল, ‘সেই ব্যবস্থাই কর।’ সহদেব বলল, ‘একটুকুন বসুন বাবু,’ এই বলে দোকান বন্ধ করার জন্য সব গুছিয়ে নিলো।

লক্ষ্মীও হাতে হাতে সাহায্য করল। দোকান বন্ধ করে ওরা দু’জন আগে আগে চলল, প্রদীপ গাড়ী চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাই গাড়ী টেনে নিয়ে ওদের পিছন পিছন চলল।

গেট দিয়ে ঢুকে দেখল চারিদিক অন্ধকার। বোধহয় পাওয়ার নেই, টেন্টের রাস্তার বাতিগুলোও জ্বলছে না। তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। কিছুসময় এইভাবে চলার পর সহদেব বলল, ‘এই যে বাবু, এই হেথা!’ অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হচ্ছিল না। আচমকা বিদ্যুৎ চমকে ওঠায় প্রদীপ দেখল একটা ব্যারাকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে দেশলাই জ্বেলে ওর ঘরের চাবি খুলল, মোমবাতি জ্বেলে চাবি দিয়ে পাশের ঘর খুলে দিল। মোমবাতিটা সহদেব ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘বাবু, ঘরে ঢুকে যান।’ ইতিমধ্যে লক্ষ্মী ওদের ঘরে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দিয়েছে। মোমের আলোয় এবার চারিদিক দেখল সে। ব্যারাক বলতে যা বোঝায় তাই – বারান্দা কমন। পাশাপাশি চারটি ঘর, কোণেরটা সহদেবের, তার পাশেরটাতে ওকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, আর তার পাশে আরো দুটি। সব ঘরই তালাবন্ধ।

প্রদীপ ঘরে ঢুকে দেখল একটা দড়ির খাটিয়া আছে, আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই। পেছন দিকে একটা দরজা, দরজা খুলে দেখল একপাশে একটু রান্নার জায়গা, সেখানে কিছু বাসনপত্র স্টোভ ইত্যাদি অন্যদিকে বাথরুম। বাইরে তাকিয়ে দেখল বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। চারিদিকটা কেমন গুমোট হয়ে আছে।

পাওয়ার এসে গেলে রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে উঠলো। ঘর বারান্দা সব আলো সুইচ টিপে জ্বেলে দিল সে। গাড়ীটা মোছা দরকার। তাড়াতাড়ি দোকানে ঢুকে পড়েছিল, তাই জামা প্যান্ট তেমন ভেজেনি। সে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলে গেঞ্জী আর বারমুডা পড়ে বারান্দায় গাড়ীটাকে তুলে আনল, তারপর ডাস্টার বার করে মুছতে লাগল। মুছতে মুছতে খেয়াল করল বোতল আর গ্লাস নিয়ে সহদেব বসে গেছে। ওকে দেখে সহদেব বলল, ‘কি বাবু, চলবে নাকি একটুকুন?’ হাতের ইশারায় সে না বলল। গাড়ী মোছা হয়ে গেলে বাস্কেট থেকে ব্যাগ বার করল, একটা ছোট তোয়ালে আর একটা সাবান তার ব্যাগে সবসময় থাকে। সাবান তোয়ালে নিয়ে সে বাথরুমে গেল। সে যখন স্নান করে বেরল, দেখল পরিপাটি করে খাটিয়াতে বিছানা করে দিয়েছে লক্ষ্মী। এবার লক্ষ্মী একটা লুঙ্গি দিয়ে ফিক্‌ করে হেসে চলে গেল। চোখাচোখি হলেই ও হেসে দিচ্ছে। ওর এই ব্যবহার বেশ উপভোগ করছিল প্রদীপ। লুঙ্গিটা পড়ে বেশ জুত করে বিছানায় বসে সে একটা সিগারেট ধরাল।

এবার সহদেবের গান শোনা গেল – ‘বড়নোকের বিটিলোক লম্বা লম্বা চুল – এমন মাথায় বেন্ধে দিব…’ প্রদীপ বুঝল সহদেবের নেশা ধরেছে। রাত দশটা বাজল। জাতে মাতাল, তালে ঠিক। হেঁকে বলল, ‘লক্ষ্মী-ই বাবুর খাবার দিয়ে আয়।’ লক্ষ্মী এসে আসন পেতে, জল গড়িয়ে খাবার দিয়ে গেল। ওরা সাঁওতাল না মুন্ডা জানে না প্রদীপ, কিন্তু অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা দেখে ভালই লাগল ওর। ডিমের কষা আর রুটি, সঙ্গে পেয়াঁজ, লংকা আর আচার। খিদেটাও বেশ চাগিয়ে উঠেছিল। বসে খেতে লাগল। এরমধ্যে লক্ষ্মী শুধিয়েছে আর রুটি লাগবে নাকি, সে ইশারায় দিতে বারণ করেছে। রাত্রীবেলা চারটের বেশী রুটি খায় না। খাওয়া হলে মুখ ধুয়ে আবার বিছানায় বসল সে। আর একটা সিগারেট ধরাল সে। গুমোট আবহাওয়ায় প্রচণ্ড গরম করছে। উঠে পাখাটা চালাল। এখনো এঁটো বাসন নিতে এল না লক্ষ্মী। ভাবল ধুয়ে রাখবে কিনা। কিন্তু ক্লান্তিতে আর ইচ্ছে করল না, শুয়ে পড়ল সে। দরজাটা ভেজানো ছিল। মাঝ রাতে দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আবার বিদ্যুতের আওয়াজ আর ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

প্রদীপ খেয়াল করল, দরজা খুলে পায়ে পায়ে ভিতরে এগিয়ে আসছে এক নারীমূর্তি, তাকিয়ে দেখল সে আর কেউ না, লক্ষ্মী। পিঠে এলানো চুলের রাশি, সদ্যস্নাত, প্রায় নিরাভরণা, শুধু একটা হাল্কা রঙের শাড়িতে উন্মত্ত যৌবন ঢাকা। এক ঝটকায় বিছানায় উঠে বসল সে, ‘একি তুমি! এতো রাত্রে?’ গুটি গুটি এসে ঠিক পায়ের কাছটিতে বসল লক্ষ্মী। বলে, ‘বাবুসাহেব, আপুনির কাছে একটা চাইবার আছে।’ ‘কি চাও?’ বলে সে। লক্ষী যা বলল, তা হল – পাঁচ বছর ওদের বিয়ে হয়েছে। সহদেব এখনো কোন সন্তান দিতে পারেনি ওকে। তাছাড়া স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কও ওদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি কখনো, কারণ সহদেব মদ, আর ডিউটি ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। দোকানে যায় মদের টাকায় টান পড়লে। নয়ত লক্ষ্মীই দোকান চালায়। সুখ কোনদিন পায় নি সে। ইতিমধ্যে আর্মির ডাক্তারদিদি তাকে পরীক্ষা করে বলেছে, যে বাচ্চা না হবার মত কোন দোষই নেই ওর। ওদের সমাজের প্রায় সব পুরুষই এরকম মাতাল দুশ্চরিত্র, তাই তার সন্তান ওরকম হোক তা সে চায় না। তার মত পুরুষের সন্তান সে ধারণ করতে চায়।

এইসব কথা বলতে বলতে লক্ষ্মী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, ‘বাবু আমাকে ফিরায়ে দিবেন না।’ এই বলে এক আকুতি নিয়ে সে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রদীপ প্রথমে চমকে উঠে বলল, ‘না না, এ কি করে হয়? তুমি চলে যাও! তাছাড়া সহদেব…’ কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই সে বলল, ‘আজ আমদানীটো ভালই, উ এখন মাল খেয়ে হুঁশ নেই, কাল সকালের আগে উঠবেক লাই।’ অশ্রুসজল চোখে সে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। হালকা বিদ্যুতের আলোয় ওর ঐ মুখ দেখে মায়া হল প্রদীপের। আস্তে আস্তে ওর মুখটা তুলে ধরতেই লক্ষ্মী ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওর চুলের উগ্র তেলের গন্ধ আর শরীরের বন্যতায় সে মাতাল হয়ে গেল। এক অনাস্বাদিত অনুভূতিতে তার দেহমন ভরে উঠল। এরপর প্রদীপ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না – এক আদিম খেলায় ওরা মেতে উঠল। পরপর তিনবার – চরম পরিতৃপ্তি না পাওয়া অবধি লক্ষ্মী নিজেকে উজাড় করে দিল। আর প্রদীপ পেল এক অজানা স্বাদ, এক অচেনা অনুভূতি।

সবশেষে লক্ষ্মী নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ওকে একটা প্রণাম করল। তারপর দ্রুত পায়ে চলে গেল। প্রদীপের মনে হল ভালোবাসা নয়, যৌন আকর্ষণ নয়, যেন দেবতার কাছে লক্ষ্মী নিজেকে সঁপে দিল শুধু একটা সন্তানের আশায়।

সে জানে না ওর আশা সে পুরণ করতে পারবে কিনা, আর ভাবতে পারল না সে। পরিতৃপ্ত ক্লান্ত শরীরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল সহদেবের ডাকে, ‘বাবু, আটটা বাজল উঠবেন নাই!’ প্রদীপ চোখ মেলে দেখল ঘরে সূর্যের আলো এসে পড়েছে, রাতের দুর্যোগের চিহ্নমাত্র নেই। আকাশও পরিস্কার। তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুমে গেল। রেডি হয়ে বেরোতে দেরী হল না। সহদেব একগাল হেসে চা বিস্কুট ধরল তার সামনে। ওর নির্মল হাসি কেন জানি মনে এক অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলল। সকালবেলা লক্ষ্মী তার সামনে আর আসে নি। আসবার সময় আরো একশ টাকা সহদেবের হাতে গুঁজে দিল সে। সহদেবের চোখ চকচক করে উঠল। গাড়ী স্টার্ট দেবার সময় সে বলল, ‘বাবু, আবার আসবেন।’ প্রদীপ কিছু না বলে বেরিয়ে এল। এরপর কতদিন ইচ্ছা হয়েছে লক্ষ্মীর কাছে যাবার, কিন্তু কি যেন একটা দ্বিধা, সংকোচ তাকে বার বার টেনে ধরেছে। আস্তে আস্তে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে সব।

*****

‘কিগো অন্ধকারে বসে আছ, আলো জ্বালাও নি কেন?’ সুমিতার কথায় সম্বিত ফিরল তার। সুমিতাই আলো জ্বেলে দিল। চা করল, চা নিয়ে প্রদীপের পাশে এসে ওকে চা দিয়ে বসল, বলল, ‘তুমি এত কি চিন্তা করছ দু’দিন ধরে, কোন পল্পের প্লট মাথায় এসেছে নাকি?’ ও জানে গল্পের প্লট মাথায় এলে প্রদীপ নাওয়া খাওয়া সব ভুলে যায়।

প্রদীপের মনে হল গল্পই তো – যদি নিছক একটা গল্প হয়, তবে তো ভালই। উত্তরে কিছু না বলে সে বলল, ‘কোথায় কি শপিং করলে দেখাও।’ এরপর তারা কেনা জিনিস দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রদীপ চিন্তামুক্ত হয়ে সুমিতার সঙ্গে কেনাকাটার আলোচনা করতে লাগল। পরের দিন সে সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে গাড়ী নিয়ে এল।

*****

এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। নিজের সংশয় মেটাতে একদিন প্রদীপ লক্ষ্মীর কাছে গিয়েছিল। এতদিন পর প্রথমটায় ওকে চিনতে না পারলেও পরে চিনেছে। চিনতে পেরে একটা গড় হয়ে প্রণাম করে বসতে বলেছে। তারপর বলেছে – বাবুকে সে তারপর অনেকদিন আশা করেছিল। বিশেষ করে সেদিন, যেদিন ও জানতে পেরেছিল ও মা হতে চলেছে। সত্যই বাবু তার কাঙ্ক্ষিত ধন দিতে পেরেছে।

সহদেব ভাল স্বামী হতে না পারলেও ভাল বাবা হতে পেরেছিল। বাসুদেব যেদিন জন্মায় সেদিন আহ্লাদে আটখানা হয়ে ব্যরাকশুদ্ধু সবাইকে ডেকে মিষ্টি খাইয়েছে। হাইওয়ে হবার সময় দোকানটা উঠে যায়। ডিউটি ছাড়া বেশীরভাগ সময় ছেলেকে নিয়েই কাটাত সহদেব। ছেলের প্রতি ভালবাসা ও চিন্তা দেখে লক্ষ্মীর ওর প্রতি সমস্ত রাগ ক্ষোভ অভিমান দূর হয়ে গিয়েছিল। সহদেবের ছেলে হয়েই ও বড় হতে লাগল। যখন পাঁচ বছর বয়েস, তখন আর্মির বড়সাহেবকে ধরে প্রাইমারী ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। সময় মত স্কুলে যাতায়াত করানো, বইপত্র কিনে দেওয়া, সবদিকেই নজর ছিল সহদেবের। ছেলে বড় হবার পর সহদেব মদ ছেড়ে দিয়েছিল। এ যেন এক নতুন মানুষকে দেখেছিল লক্ষ্মী। বাবুর কথা আর তার মনে পড়েনি। সব ভুলিয়ে দিয়েছিল সহদেব তার ব্যবহারে। বড় হবার পর বাসুদেবেরও বাবা অন্ত প্রাণ ছিল। যখন বাসুদেব স্কুল ফাইনাল পাশ করল, তখন লিভারের অসুখে সহদেব মারা যায়। আর্মির সাহেবদের ধরে সহদেবের চাকরীটা পেয়েছিল লক্ষ্মী। তারপর বাসুদেব নিজের চেষ্টাতেই সব করেছে।

এতদিন পর বাবু কে পেয়ে সবকথা উজাড় করে দিল সে; কিন্তু এও বুঝিয়ে দিল যে বাসুদেব তারই দেওয়া আশীর্বাদ হলেও ওদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রদীপের কোন স্থান নেই। সহদেবের ছেলে হয়েই ও বেঁচে থাকবে। বয়েসের সাথে সাথে লক্ষ্মীর কথাবার্তার বলিষ্ঠতা প্রদীপকে অবাক করেছিল। প্রদীপ ফিরে এসেছিল, কিন্তু ফিরে এসেছিল একটা চরম তৃপ্তি নিয়ে – এই তো তারই ছেলে – সেই ছেলেটা।