অমিত কুমার মাঝি

 

‘নরেন ওঠ, অনেক বেলা হয়ে গেছে।’ সবে মাত্র মর্নিংওয়াক থেকে ফিরে এসে ডাক দিলেন নরেনের বাবা। তিনি চেন দিয়ে ধরে আছেন একটা কুকুরকে। কুকুরটা ডাক দিল, ঘেউ, ঘেউ।

নরেন দু’হাত দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আমি উঠে গেছি। তোমার মর্নিংওয়াক হয়ে গেল?’ এই বলে সে কুকুরটার চেনটা তার বাবার হাত থেকে নিয়ে তার নির্ধারিত জায়গাতে বেঁধে দিল। নরেনের বাবা বললেন, ‘তুই রেডি হয়ে নে। তা না হলে তোর অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি কর।’

এই হল নরেন আর তার বাবার প্রতিদিন সকালের কথোপকথন। এরপর নরেন অফিসে বের হয়ে যায় আর বাড়িতে থেকে যান তার বাবা।
নরেনের এক দিদি আছে, কয়েক বছর আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে। নরেনই তার বাবার কাছে থাকে। সে তার বাবার খুব পছন্দের পাত্র। অল্প বয়সে তার মা মারা গেলে তার বাবাই আদরে যত্নে ভালবাসায় তাকে মানুষ করে তুলেছেন।
সত্তর বছর বয়সী নরেনের বাবার সব সময়ের সঙ্গী তাঁর পোষা কুকুরটা। বাড়িতে বিশ্বস্ত একজন কাজের লোক আছে, তাই তাঁর বিশেষ কোন অসুবিধা হয় না।

একদিন নরেন আর তার বাবা একসঙ্গে রাতের খাবার খাচ্ছে।
নরেনের বাবা বললেন, ‘হ্যাঁরে, রাধিকা কেমন আছে? তাকে তো অনেক দিন দেখি না।’
রাধিকা নরেনের গার্লফ্রেন্ড। মাঝে মাঝেই তার বাবার কাছে আসে এবং গল্প-টল্প করে যায়।
নরেন বলল, ‘ও ভালোই আছে, এখন একটু ব্যস্ত তাই এদিকে আসতে পারছে না।’
‘তোদের বিয়েটা দেখে যেতে পারলে ভালোই হত।’
‘তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ!’
‘না, বলা তো যায় না। আজ আছি কাল নেই।’
‘বাবা, তুমি সব সময় একই কথা বল কেন। তোমার কি আর কিছু বলার থাকে না।’
একটু থেমে সে বলল, ‘তুমি তো চোখে কম দেখ, তাই ভাবছিলাম তোমায় ডাক্তার দেখাব।’
‘ও সবের আর দরকার নেই, বুঝলি। ডাক্তার-ফাক্তারের আর দরকার নেই।’
‘না না, তা বললে কি হয়।’ একটু থেমে সে আবার বলল, ‘যদি সে রকম, মানে যদি নতুন চোখ লাগে, তার ব্যবস্থা করা যাবে। প্রয়োজন হলে আমিই না হয় একটা চোখ দিয়ে দেব। তুমি নতুন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে।’
‘শোন তাহলে, তোকে একটা কথা বলি। সারা জীবনে এত দেখেছি, এত শুনেছি, এখন আর দেখতে শুনতে ইচ্ছে করে না। আমার চেনা দুনিয়ার জানা লোকেরা সারা জীবনে এত দুঃখ-কষ্ট দিয়েছে, এ দুনিয়াকে নতুন করে দেখার কোনো ইচ্ছে নেই। এই ভালো আছি, অল্প দেখি, অল্প শুনি, ভালোই। নতুন দৃষ্টি নিয়ে আমার স্বপ্নের দুনিয়ার ধূসর রঙ আমি দেখতে চাই না। আমি তো হাতে গোনা আর কটা দিন বাঁচব। তোর সামনে এখন অনেক রাস্তা বাকি পড়ে আছে, তোকে সেই পথে হাঁটতে হবে সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে, একটু এদিক-ওদিক হলেই বিপদ। আমার একটাই ইচ্ছে, আমার কল্পনার আদর্শ দুনিয়া তোর জীবন জুড়ে থাকুক আর তুই সেটাকে দু’চোখ দিয়ে উপলব্ধি কর। এটাই আমার ভগবানের কাছে একমাত্র প্রার্থনা।’
এরপর নরেন আর কিছু বলল না। তাদের খাওয়া হয়ে গেলে যে যার ঘরে চলে গেল।

প্রতিদিন সকালে নরেনের বাবা মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে এসে নরেনকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে দেন। আজ নরেন ঘুম ঠিক সময়েই ভেঙেছে কিন্তু তার বাবার ডাকে না, কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দে। সে বিছানা থেকে বলল, ‘বাবা আমি উঠে গেছি।’ কিন্তু বাইরে থেকে কোন উত্তর এল না।

সে বিছানা থেকে উঠে দু’হাত দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে দরজা খুলে বাইরে এসে বলল, ‘আমি উঠে গেছি। তোমার মর্নিং ওয়াক হয়ে গেল?’
এ কথা বলার পর চোখ খুলে সে তার বাবাকে না দেখতে পেয়ে তার বাবার ঘরের দিকে তাকিয়ে ডাক দিল, ‘বাবা’। এবারও সে কোন উত্তর পেল না।
এদিকে কুকুরটা বাঁধা অবস্থায় চিৎকার করেই চলেছে। কুকুরের ডাক শুনে তার মনে হল, ডাকের মধ্যে কোথাও একটা বেদনা জুড়ে আছে। তার কেমন যেন একটা ভয়-ভয় করতে লাগল। সে তার বাবার ঘরের কাছে এসে ডাক দিল, ‘বাবা, বাবা। এখনও ওঠো নি! অনেক বেলা হয়ে গেছে। হাঁটতে যাবে না?’
ভেতর থেকে কোন উত্তর এল না।
নরেন অনেক বলা সত্ত্বেও নরেনের বাবা দরজা ভেজিয়ে ঘুমাতেন। ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখল, তার বাবা শুয়ে আছেন। এতে নরেন অবাক হয়ে বলল, ‘বাবা অনেক বেলা হয়ে গেছে, ওঠো। মর্নিং ওয়াকে যাবে না?’
এই বলেই সে তার বাবার গায়ে হাত দিয়ে দেখে, তাঁর শরীর বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে। নরেন বুঝতে পারল, তার বাবা চিরদিনের মত ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছেন। নরেন দুঃখে কাঠের মত দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
তারপর সে প্রথমে কল করল রাধিকাকে। রাধিকা আসতেই সে তার দিদি-জামাই বাবুকে ফোন করে।
নরেনের দিদি এসেই কান্নায় এক্কেবারে ফেটে পড়ল।
এদিকে কুকুরটা সমানে চিৎকার করেই চলেছে।

বেশ কিছু দিন কেটে গেছে। নরেনের বাবার পোষা কুকুরটা কিছু না খেয়ে খেয়ে, সারাক্ষণ চিৎকার করতে করতে, একদিন মারাই গেল। কুকুরটা মারা গেলে তার বাড়ির চাকরটা বলল, ‘ছোটবাবু, কুকুরটা বাবুর শোকে না খেয়েই মারা গেল। বাবুর খুব ন্যাওটা ছিলো কি না, বাবুর হাতে ছাড়া কারো হাতে খেতোই না।’

নরেনের মধ্যে আগেকার সতেজতা আর নেই, কেমন যেন সব সময় সে মনমরা হয়ে থাকে। সে রাধিকা বা তার দিদিকে ফোন করা ছেড়েই দিয়েছে। নরেনের দিদি বেশি দূরে থাকে না। সে কয়েক বার এসে নরেনকে দেখে গেছে। নরেনকে সে অনেক বুঝিয়েছে, ‘এত দুঃখ করলে কি করে চলবে বল?’
নরেন খুব দুঃখের সঙ্গে বলেছে, ‘বাবাকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।’
‘কি করবি বল, কারো বাবা মা কি আর চিরকাল থাকে? মনে মনে শক্ত হ। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তার দিদি তাকে অনেকবার বলেছে, ‘তুই এইবার রাধিকাকে বিয়ে করে নে।’
নরেন বলছে, ‘বিয়ে করার সময় কি চলে যাচ্ছে। যখন হোক করলেই হল।’

এদিকে রাধিকা এসে তাকে বলেছে, ‘তুই না দিন দিন কেমন পাল্টে যাচ্ছিস। ফোন-টোন তো বন্ধ করে দিয়েছিস। চল কোথাও একটা ঘুরে আসি। একলা ঘরে বন্দী থেকে তুই কেমন দিন দিন পাগলের মত হয়ে যাচ্ছিস।’ নরেন রাধিকার কোন কথার উত্তর দেয় না।
রাধিকা বলল, ‘আমরা না পুরো ফ্যামিলি নিয়ে দার্জিলিং বেড়াতে যাচ্ছি, তুইও আমাদের সঙ্গে চল; দারুণ মজা হবে।’
নরেন কিছুতেই রাজি হল না বেড়াতে যাবার জন্য।

অনেক দিন কেটে গেছে, বাইরের লোকেদের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগই নেই। বাড়ির চাকরটাকে বেশ কিছু দিন আগে সে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
নরেন আজকাল এক প্রকার বন্দীর মত সময় কাটায়। বাইরে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। সে কি যেন এক গভীর চিন্তায়, গভীর দুঃখে সর্বদাই ডুবে থাকে।
তখন গভীর রাত্রি, নরেন একলা তার নিজের ঘরে চুপচাপ বিছানার উপর স্থিরভাবে বসে আছে। তার মনে হতে লাগল, কুকুরটা যেন আগের মত আবার চিৎকার করছে। কিন্তু অনেক দূর থেকে। তার কানে অস্পষ্টভাবে আসতে লাগল সে আওয়াজ। বিছানায় বসে বসে সে বলল, ‘আমি কেন বেঁচে আছি!’
হঠাৎ তার মনে হল, কুকুরটা যেন তার বাবার ঘরে ঢুকল। সে অতি সর্তকতার সাঙ্গে তার বাবার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই। সে তার বাবার বিছানায় শুয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করল; কিন্তু সে ঘুমোতে পারল না। সে তার বাবার ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে কুকুরটা যেখানে বাঁধা থাকত ঠিক সেইখানে এসে দাঁড়াল। এরপর সে কুকুরের গলার বেল্টটা তার গলায় পরে নিয়ে সেখানেই পড়ে রইল।

রাধিকা দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে নরেনকে দেখতে এল। সদর দরজা থেকে সে অনেকক্ষণ, ‘নরেন, নরেন’ বলে ডেকে, কোন উত্তর না পেয়ে, দরজায় ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। দরজা খুলতেই সে কুকুরের অদ্ভুত চিৎকারে চমকে উঠে দেখল, একটা উস্কো-খুস্কো লোক মুখময় দাড়ি নিয়ে কুকুরের মত চিৎকার করছে। সে আবার লোহার চেনে আটকানো। রাধিকা ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘নরেন!’
সে উত্তর দিল, ‘ঘেউ।’